মমতা বন্দোপাধ্যায় ফুটবলে এত আগ্রহী হয়ে উঠলেন কেন?
Why did Mamata Banerjee become so interested in football?

Truth Of Bengal: জয়ন্ত চক্রবর্তী: স্বীকার করি আর না করি, বাঙালির সিগনেচার হল এই পাঁচটি বস্তু– সকালের জলখাবারে লুচি কিংবা পরোটা, দুপুরে মাছ-ভাত, রবীন্দ্রনাথ, উত্তমকুমার আর ফুটবল। বাঙালি হয়ে জন্মেছেন আর সকালের ব্রেকফাস্টে লুচি কিংবা পরোটা থাকবে না তা হয় নাকি? কথায় বলে মাছে-ভাতে বাঙালি। পাতে এক টুকরো মাছ না থাকলে বাঙালির রক্তচাপ যে ঊর্ধ্বমুখী হয়, তা বোঝার জন্য আলাদা মস্তিষ্কের দরকার হয় না।
এক বিদেশি সমালোচক মারি সিটন বহু বছর আগে সত্যজিৎ রায়ের শ্রেষ্ঠত্ব বোঝাতে গিয়ে এই আলাদা মস্তিষ্কের উল্লেখ করেছিলেন। আজ তাক বুঝে সেটা আমার এই লেখায় চিপকে দিলাম। এটাও বাঙালির আর এক কৃতিত্ব সুযোগ সন্ধানী হওয়া। তবে, যাক সে কথা। তৃতীয়ত, বাঙালির আর এক সিগনেচার হল রবি অনুরাগী হওয়া। পড়ি চাই না পড়ি, বাড়িতে রবীন্দ্র রচনাবলীর এক সেট না থাকলে আপনি কিসের বাঙালি?
পঁচিশে বৈশাখ ঘাড়ে পাউডার ঘষে যদি না ‘কে বলেগো সেই প্রভাতে নেই আমি’ আউড়াতে না পারেন তা হলে আপনি কিসের বাঙালি? ম্যাটিনি শো-এ ম্যাটিনি আইডল উত্তমকুমারের ভুবনমোহন হাসির যদি ফ্যান না হন তা হলে আপনার বাঙালি জন্ম বৃথা। আর লাস্ট অফ দা লিস্ট হল- বাঙালি মাত্র ফুটবলবোদ্ধা।
বলে লাথি মারুন বা না মারুন গ্যালারি কিংবা পাড়ার চায়ের দোকানে বসে আপনার ফুটবল সমালোচক হতে আপত্তি কোথায়? আপনি যদি নির্ভেজাল বাঙালি হন তা হলে জন্ম ইস্তক আপনি মোহনবাগান কিংবা ইস্টবেঙ্গল। কেউ কেউ মহমেডান স্পোটিং-এর সমর্থকও হন না এমন নয়। চায়ের কাপে তুফান তুলতে বাঙালির এই ফুটবল প্রীতির কি কোনও তুলনা আছে! বাঙালি আজন্ম ফুটবল প্রেমী, তাতে আর সন্দেহ কী!
হচ্ছিল আমাদের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের ফুটবল নিয়ে আগ্রহর কথা, চলে গেলাম বাঙালি হওয়ার বৈশিষ্ট্যর কথায়। এই ধান ভানতে শিবের গীত গাওয়ার অভ্যাসটা আজও আমার গেল না। কথা হচ্ছে আমাদের মুখ্যমন্ত্রীর এত বেশি ফুটবল প্রেম নিয়ে। বিরোধী পক্ষ বলছে যে, ২০২৬-এর ভোটব্যাঙ্কের কথা মাথায় রেখেই নাকি মুখ্যমন্ত্রীর এই ফুটবল প্রীতি। সবিনয়ে জানাই যে আজ বলে নয়, মমতা আদ্যন্ত ফুটবল ফ্যান সেই ছেলেবেলা থেকেই।
আজ যে কালীঘাট মিলন সমিতির এত নামডাক তার তো সূত্রপাত হয়েছিল ৩০ বি হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিট থেকে মমতা বন্দোপাধ্যায়ের বাবা প্রমীলেশ্বর বন্দোপাধ্যায়ের হাত ধরে। মমতার নিশ্চিত ভাবেই মনে নেই, না থাকারই কথা, মমতার মা গায়ত্রী দেবীর সঙ্গী ছিল এক ট্রানজিস্টর। বোধহয় বুশ ব্যাটন বা ব্যারণ জাতীয় কিছু হবে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলেই তিনি রেডিও-তে ফুটবল ম্যাচের রিলে শুনতেন। সেটা সত্তরের শেষ কিংবা আশির মাঝামাঝি। রেডিও-তে চুটিয়ে রিলে করছি।
মনে আছে অজিত (মমতা বন্দোপাধ্যায়ের দাদা) আমার সঙ্গে গায়ত্রী দেবীর আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন তাঁদের কালীঘাটের বাড়িতে। মমতার মা সেদিন বলেছিলেন, তুমি রেডিও-তে রিলে করো। গলাটা তোমার তো খাসা! ধান ভানতে আবার শিবের গীত। বলছি মুখ্যমন্ত্রীর ফুটবল প্রীতির কথা। তার মাঝে আবার নিজের বিজ্ঞাপন! মমতার মনে থাকার কথা নয়– আমারই সংবাদিকতার প্রত্যুষের ঘটনা।
কালীঘাট মিলন সমিতি একটা ম্যাচ খেলছিল কলকাতার লিগে। প্রতিপক্ষ কে ছিল তা আমার এতদিনে মনে নেই। শুধু মনে আছে তখন সবে যুগান্তরে ঢুকেছি। সেদিন ভবানীপুর মাঠে প্রচুর গণ্ডগোল হয়েছিল। টিয়ার গ্যাস, লাঠি চলেছিল। অভিষেক বন্দোপাধ্যায়ের বাবা অমিত বান্দোপাধ্যায় লাঠির ঘা খেতে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছিলেন।
পরে অজিত বন্দোপাধ্যায় স্বীকার করেছেন যে অমিত মাঠে খুব বেশি যেতেন না। সেদিন তাঁর পীড়াপীড়িতেই গিয়েছিলেন মাঠে। প্রথম দিনেই বিপত্তি। সেদিন সন্ধ্যায় এক রণরঙ্গিনী রমণী মূর্তিকে দেখেছিলাম হেস্টিংস থানায়। মমতা বন্দোপাধ্যায় তখন নিছক এক কংগ্রেস নেত্রী। কিন্তু সেদিন হেস্টিংস থানায় ওসি-কে বিনা প্ররোচনায় লাঠি চালানোর জন্যে সবক শিখিয়েছিলেন তিনি।
মমতা মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গলের সেই স্বর্ণযুগে বড় হয়েছেন। সুব্রত ভট্টাচার্য তাঁর বাবলু দা, সমরেশ চৌধুরী তাঁর পিন্টু দা। গৌতম-প্রসূন তাঁর গৌতম দা কিংবা গোপাল দা। তিনি বাঙালি ফুটবলারদের অর্জুন পাওয়ার জন্যে তদবির করেন দিল্লিতে। তিনি ফুটবল নিয়ে আগ্রহী হবেন না তো হবেন ও পাড়ার ওই লিসি? ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের ইনভেস্টর আনা বা মোহনবাগান ইলেকশনে নাক গলানোটা সেই ফুটবল প্রীতি থেকেই। মমতার ফুটবল আগ্রহ নিয়ে বিরোধীরা যত কটাক্ষই করুক, ফুটবল আসে আমাদের মুখ্যমন্ত্রীর হৃদয় থেকে, মস্তিস্ক থেকে নয়!