সম্পাদকীয়

যুদ্ধ ও মনস্তত্ব

War and mentality

অনন্যা ভট্টাচার্য্য (মনোবিদ):

যুদ্ধের মনস্তত্ত্ব

যুদ্ধের মনস্তত্ত্ব বলতে বোঝায় এমন এক মানসিক অবস্থা যেখানে ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা রাষ্ট্র সামরিক সংঘাতকে মনস্তাত্ত্বিক ভাবে গ্রহণ করে এবং সংঘাতে অংশগ্রহণের জন্য মন ও চিন্তাকে প্রস্তুত রাখে। এতে জাতীয়তাবাদ, প্রতিশোধস্পৃহা, আত্মরক্ষা, ভয় এবং ঘৃণা ইত্যাদি আবেগ জড়িয়ে থাকে। যুদ্ধের সময় মানুষ বা জনগোষ্ঠী ‘‘আমরা বনাম ওরা’ বিভাজনের মধ্য দিয়ে যায়। এতে শত্রুপক্ষকে অমানবিক বা ‘অপর’ করা হয় যাতে যুদ্ধের নৈতিক দ্বিধা কমে যায়।

কূটনৈতিক মনস্তত্ত্ব যুদ্ধকালীন প্রেক্ষিতে কোন অবস্থায় থাকে?

যুদ্ধকালীন সময় কূটনৈতিক মনস্তত্ত্ব সাধারণত দ্বন্দ্ব-সমাধান ও স্বার্থরক্ষার মাঝে দোদুল্যমান থাকে। অধিকাংশ রাষ্ট্র যুদ্ধের মাঝেও কূটনৈতিক সংলাপ চালিয়ে যায় যাতে নিজেদের কৌশলগত সুবিধা নিশ্চিত থাকে। এই মনস্তত্ত্ব সংকট মোকাবেলায় বাস্তববাদ ও কৌশলগত ধৈর্য্য-এর মিশ্রণ। যুদ্ধ চলাকালীন সময় শান্তি আলোচনা, অস্ত্রবিরতি চুক্তি, তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্থতা ও আন্তর্জাতিক চাপ মোকাবেলা করার মানসিক প্রস্তুতি কূটনীতিকদের রাখতে হয়।

যে কোনও সন্ত্রাস দমনেই কি যুদ্ধ একমাত্র পদ্ধতি?

না, যুদ্ধ বা সামরিক শক্তি প্রদর্শন সন্ত্রাস দমনের একমাত্র উপায় নয়। সন্ত্রাস দমন কার্যক্রম বহুমাত্রিক হতে হয়। এতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ, অর্থনৈতিক অবরোধ, সন্ত্রাসীদের অর্থায়নের পথ রোধ, মতাদর্শগত মোকাবিলা, সামাজিক সংহতি বৃদ্ধির উদ্যোগ, শিক্ষা ও দারিদ্র্য বিমোচনের মতো নরম কৌশল প্রয়োগ জরুরি। যুদ্ধের মাধ্যমে সন্ত্রাস দমন করলে অনেক সময় ‘কো ল্যাটারাল ড্যামেজ’ অর্থাৎ নিরীহ মানুষের প্রাণহানি ঘটে, যা দীর্ঘমেয়াদে আরও উগ্রপন্থা জন্ম দিতে পারে। সুতরাং, যুদ্ধ প্রয়োজনীয় হলেও একমাত্র সমাধান নয়।

যুদ্ধ কীভাবে শিশুর মনোবিকাশে ছাপ ফেলে?

যুদ্ধ শিশুর মনোবিকাশে গভীর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। শিশুরা নিরাপত্তাহীনতা, আতঙ্ক, প্রিয়জন হারানোর শোক, বাস্তুচ্যুতি ইত্যাদি সমস্যার সম্মুখীন হয়। এতে তাদের আস্থা, সামাজিক সম্পর্ক গড়ার ক্ষমতা, শেখার আগ্রহ কমে যায়। পোস্ট ট্রমাটিক ডিসঅর্ডার, ঘুমের ব্যাঘাত, দুঃস্বপ্ন, বিষণ্ণতা, আঘাতজনিত উদ্বেগ ইত্যাদি দেখা দেয়। অনেক শিশু আগ্রাসী আচরণ বা আবেগ নিয়ন্ত্রণের সমস্যায় ভোগে। খেলাধুলো, পড়াশোনা, স্বাভাবিক শৈশব হারিয়ে যায়। এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব তাদের ব্যক্তিত্ব ও ভবিষ্যৎ জীবনে ছায়া ফেলে।

যে কোনও পূর্ণবয়স্ক মানুষের মনোসামাজিক দিক কীভাবে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে সমস্যায় পড়তে পারে?

পূর্ণবয়স্করা যুদ্ধের সময় আর্থিক অনিশ্চয়তা, চাকরি হারানো, পরিবার বিচ্ছিন্ন হওয়া, সামাজিক সংহতি ভাঙা, শারীরিক ক্ষয়ক্ষতি, খাদ্যাভাব ইত্যাদিতে ভোগে। সামাজিক সম্পর্ক নষ্ট হয়, পারিবারিক কলহ বেড়ে যায়। ট্রমা ও বিষণ্ণতা কারণে মানসিক স্থিতিশীলতা নষ্ট হয়। অনেক সময় পুরুষদের মধ্যে ‘পুরুষত্বের সংকট’ দেখা দেয় (যুদ্ধে ভূমিকা পালন করতে না পারার হতাশা)। মহিলারা যৌন সহিংসতা, লিঙ্গভিত্তিক নিপীড়নের শিকার হয়। সামাজিক সমর্থন ব্যবস্থার ভেঙে পড়া আরও সংকট সৃষ্টি করে।

যুদ্ধ চলাকালীন মানসিক আঘাত বা ট্রমা কোন কোন পথে আসতে পারে?

১. সরাসরি ট্রমা– যুদ্ধক্ষেত্রে বা বোমা হামলায় আহত হওয়া, ধর্ষণ, নির্যাতন ইত্যাদি।

২. পরোক্ষ ট্রমা– প্রিয়জনের মৃত্যু দেখা, শরণার্থী শিবিরে দুর্দশা সহ্য করা, বাড়িঘর ধ্বংস হওয়া।

৩. সাক্ষী ট্রমা– গণমাধ্যমে নৃশংসতা দেখা, অন্যের ভোগান্তির সংবাদ শোনা।

৪. উপেক্ষিত ট্রমা– প্রাথমিকভাবে ট্রমা স্বীকার না করা, কিন্তু পরবর্তীতে আচরণগত সমস্যা দেখা দেওয়া।

৫. জেনারেশনাল ট্রমা– একটি প্রজন্মের ট্রমা ভবিষ্যৎ প্রজন্মে রূপান্তরিত হওয়া।

যুদ্ধকালীন শিশুদের মানসিক ট্রমা সামলাবেন কীভাবে?

১. নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ– শিশুকে শারীরিক ও মানসিক নিরাপদ পরিবেশ দেওয়া।

২. নিয়মিত রুটিন বজায় রাখা– খাওয়া, ঘুম, খেলা, পড়াশোনা– সাধারণ শৈশব ফিরিয়ে আনা।

৩. খোলামেলা কথা বলা– শিশু যেন আবেগ ও ভয় প্রকাশ করতে পারে, সে সুযোগ সৃষ্টি করা।

৪. মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা– শিশু-কেন্দ্রিক কাউন্সেলিং ও থেরাপি (যেমন প্লে থেরাপি)।

৫. শিক্ষা ও সৃজনশীলতা– আঁকা, গান, নাটক, গল্পের মাধ্যমে মনোবিকাশের সুযোগ।

৬. সামাজিক সংহতি– একত্রে থাকা, সমবয়সীদের সঙ্গে মেলামেশা পুনঃস্থাপন।

যুদ্ধকালীন পূর্ণবয়স্ক মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যকে কীভাবে সামলাবেন?

১. কাউন্সেলিং ও মানসিক চিকিৎসা– ট্রমা থেরাপি, জ্ঞানীয় আচরণগত থেরাপি, সাপোর্ট গ্রুপ।

২. সামাজিক সমর্থন– পরিবার, বন্ধু, স্থানীয় কমিউনিটির সঙ্গে সংযোগ বজায় রাখা।

৩. ব্যক্তিগত যত্ন– পর্যাপ্ত বিশ্রাম, স্বাস্থ্যকর খাওয়া, দৈহিক ব্যায়াম।

৪. আত্মপ্রকাশ– ডায়েরি লেখা, আর্ট, সংগীত, গল্প বলা ইত্যাদি মাধ্যমে আবেগ প্রকাশ।

৫. আশা ও অর্থপূর্ণতা খোঁজা– স্বেচ্ছাসেবা, ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক চর্চা— যা মানসিক শক্তি দেয়।

৬. পেশাগত সহায়তা– মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া, প্রয়োজনে ওষুধ সেবন।

সর্বোপরি, যুদ্ধ শেষ হলেও দীর্ঘমেয়াদি মানসিক পুনর্বাসনের প্রয়োজন থাকে। ব্যক্তি, পরিবার ও রাষ্ট্র-সমূহের সমন্বিত চেষ্টায় মনস্তাত্ত্বিক আরোগ্য সম্ভব।

Related Articles