সম্পাদকীয়

ভিউস বনাম মূল্যবোধ: হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের সমাজের বিবেক

Views vs. Values: Our Society's Conscience Is Losing

মহম্মদ মফিজুল ইসলাম: একটা সময় ছিল যখন ‘ভালো কনটেন্ট’ বলতে বোঝাত— জ্ঞানচর্চা, কবিতা, সাহিত্য, ইতিহাস, সংস্কৃতি, দর্শন কিংবা সমাজবিষয়ক আলোচনা। মানুষ ভাবত, শেখা মানেই এগিয়ে যাওয়া। ভাবা হতো, গঠনমূলক চিন্তা, মননশীলতা এবং সৃজনশীলতা সমাজের ভিত গড়ে তোলে। কিন্তু আজ?

আজকের ‘ভালো কনটেন্ট’ মানে হলো — শরীরের প্রদর্শনী, চটকদার শিরোনাম, খিস্তি মেশানো কথোপকথন, আর একরকমের সস্তা উত্তেজনা। সামাজিক মাধ্যমের স্ক্রল করতে করতে হঠাৎই দেখা যায় — এক মহিলা টাওয়েল পরে নাচছেন, এবং তার ভিডিওতে মিলিয়ন মিলিয়ন ভিউস। অন্যদিকে, কেউ যদি একবিন্দু শিক্ষামূলক বা মননশীল কিছু প্রকাশ করেন, সেটা হয়তো পাঁচশো ভিউ ছুঁয়েই থেমে যায়।

এর থেকে বড় ট্র্যাজেডি আর কী হতে পারে?

ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম কিংবা অন্যান্য সোশ্যাল প্ল্যাটফর্ম এখন আর কনটেন্টের মান দিয়ে নয়, কনটেন্টের ‘চকচকে’ উপস্থিতি দিয়ে মানুষ বিচার করছে। কেউ সকালে নাইটি পরে আলু-পটল রান্না করছেন আর ক্যাপশন দিচ্ছেন, “দেওরকে আজ যা দিলাম!” ব্যাস, দর্শকের কৌতূহলে ভিউ বাড়তে থাকে লাফিয়ে লাফিয়ে। মানুষ ভাবে, “শেষে না জানি কী আছে?” — কৌতূহলের এই সস্তা ফাঁদে আটকে যাচ্ছে পুরো সমাজ।

অন্যদিকে, কেউ যদি জয় গোঁসাই, বাউল গান, কিংবা লোকসংস্কৃতি নিয়ে কোনো কিছু বলেন — একটুও মনোযোগ পাচ্ছেন না। কারণ, এইসব কনটেন্টের নিচে থাকে না খাঁজ, নাইটি বা সস্তা যৌন ইঙ্গিত।

মানসিকতা বদলে যাচ্ছে — কিন্তু কোন দিকে?

আমরা কি সত্যিই এতটাই নিচে নেমে গেছি, যেখানে “ভিউ” আর “লাইক” আমাদের মানসিকতার মানদণ্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে? আজকের দিনে দাঁড়িয়ে কবিতা, শিল্প কিংবা শিক্ষামূলক আলোচনা নয় — “বক্ষ বিভাজিকা”, “শায়ার কাপড়” আর “দেওরের প্রতি সেক্সুয়াল ইঙ্গিত” সমাজের কন্টেন্ট কালচার গড়ে দিচ্ছে।

কমেডিও আর বিনোদন নয় — কে কতটা সুন্দরভাবে অশ্লীল ভাষায় গালি দিতে পারে, সেটাই মাপকাঠি। খিস্তি দিয়ে মানুষ হাসাচ্ছে, আর তাতেই সোশ্যাল মিডিয়া হেসে উঠছে — হা হা হা করে। এইসব দেখে আমাদের নতুন প্রজন্ম কী শিখবে?

একটা সময় আসতে পারে, যখন ছোটোদের শেখানো হবে — “পড়াশোনায় কিছু হবে না রে, রিল বানা! ফেসবুকে খাঁজ দেখাও, নাইটি পরে নাচো, ব্যাস! তাতেই বাড়ি-গাড়ি কেনা যাবে।”

শিক্ষা, সাহিত্য, বিজ্ঞান, সমাজচিন্তা তখন শুধু পাঠ্যবইয়ের পাতায় থাকবে, জীবনের বাস্তবতায় আর নয়। আর এই পরিস্থিতির দায় শুধুই কি কনটেন্ট নির্মাতার? মোটেও নয় — দায় আমাদের সকলের, যারা এইসব দেখে যাচ্ছি, লাইক দিচ্ছি, শেয়ার করছি।

পাবলিক ডিমান্ডের নামে আমরা কী চাইছি?

সোশ্যাল মিডিয়া একটা আয়নার মতো — সেটাতে যা দেখা যাচ্ছে, তা আসলে আমাদের সামাজিক রুচি, চাহিদা, আর মনোভাবকেই প্রতিফলিত করছে। নাইটির কদর বাড়ছে, কারণ আমরা নিজেরাই তার দর্শক।

একজন মহিলা খালি গায়ে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করছেন — “দেখুন তো আমি কী পরে আছি?” — আর তার উত্তর খুঁজতে গিয়ে মিলিয়ন মিলিয়ন ভিউ দিয়ে দিচ্ছে মানুষ। এই ভিউয়ের টাকাতেই চলছে তার সংসার। এটাই কি আমাদের আসল উন্নয়ন?

আমাদের ক্রিয়েটিভিটি এখন শাড়ির ভাঁজে হারিয়ে যাচ্ছে, চিন্তাভাবনা ডুবে যাচ্ছে ক্লিভেজের গভীরতায়।

সমাধান কী?

সমাধান খুব কঠিন নয় — আমাদের রুচির জায়গাটা একটু সচেতনভাবে বদলাতে হবে। আমরা যদি সত্যিই চাই সমাজে পরিবর্তন আসুক, তবে আমাদেরই সেই পরিবর্তনের সূচনা করতে হবে।

শুধু শরীর নয়, মনও যদি সুন্দর হয় — সেই সৌন্দর্যকে গুরুত্ব দিতে শিখতে হবে। শিক্ষার, শিল্পের, সাহিত্যের কদর ফিরিয়ে আনতে হবে।

তবে একটা সমাজ আবার তৈরি হবে — যেখানে “ভিউ” নয়, “মূল্যবোধ” হবে আসল মাপকাঠি। যেখানে বউদির নাইটি নয়, এক শিক্ষকের পাঠ, এক কবির কবিতা, এক শিল্পীর ছবি — সেই সব কিছু আবার আলোচিত হবে, প্রশংসিত হবে। আর না হলে — আজকের শিশুদের আমরা কী ভবিষ্যৎ দিয়ে যাব?