সম্পাদকীয়

বাংলার বর্ষবরণের সূচনায় রয়েছে অনেক ইতিহাস

There is a lot of history behind the beginning of Bengali New Year's Eve

নৃপেন্দ্রনাথ বিশ্বাস (বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক): বসন্তের শেষ মুহূর্তে চারিদিকে সাজ সাজ রব। বাংলার লোক-সংস্কৃতি বোলান গানের মধ্য দিয়ে চৈত্র সংক্রান্তির গাজন উৎসব জানায় নতুন বছরকে আহ্বান। বাঙালির বাঙ্গালিয়ানায় বাঙ্গালিত্বের সংস্কৃতিতে, মহাসমারোহে বছরের প্রথম মাস বৈশাখের প্রথম দিনটিতে, সিদ্ধিদাতা গণেশ ও মা লক্ষ্মীদেবীকে ভক্তি ভরে আরাধনার শেষে সকলকে মিষ্টি মুখ করিয়ে বর্ষবরণ উৎসব উদযাপনের মধ্য দিয়ে নতুন বছরকে স্বাগত জানায় ।

প্রকৃতির ঋতুচক্রের দোদুল দোলনায়, চৈত্র বিদায়ের পর নবরূপে বৈশাখ দোলা দেয় প্রকৃতির প্রাঙ্গণে। নব উন্মাদনা জাগায় বাঙালির মনে প্রাণে। বাঙালির হৃদয় উন্মত্ত হয়ে ওঠে তার আপন ছন্দে। বছরের শেষে চৈত্রকে বিদায় সম্ভাষণ জানিয়ে হাস্যোজ্বল মুখে বরণডালা হাতে এগিয়ে এসে প্রস্তুত হতে থাকে বছরের প্রথম মাস বৈশাখকে স্বাগত জানাতে। আনন্দ উচ্ছ্বাসে উদ্বেলিত হয়ে ওঠে প্রতিটি আবালবৃদ্ধবনিতা। বিগত বছরের যাবতীয় না পাওয়ার বেদনা, জমে থাকা দুঃখ-কষ্ট , অপরাধ, প্রতিশোধের ঘাত-প্রতিঘাত ভুলে আরও বেশি করে সেজে মেতে উঠে আনন্দ উচ্ছ্বাসে সবার মাঝে নিজেকে ভাসিয়ে দিতে নববর্ষ উৎসব উদযাপনে। বাংলার এই নববর্ষ উৎসব আজকের নতুন নয়। বহু প্রাচীন, মধ্যযুগীয় বাঙালি সংস্কৃতির ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। অতীতের বঞ্চিত, কলুষিত দিনগুলির কথা ভুলে নির্মল স্বচ্ছ দিনের আলোয় নতুন বছরে নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখা। তাইতো বাংলার নববর্ষ উৎসব হল বাঙালির বাঙ্গালিয়ানায় বাঙ্গালিত্বকে হৃদয়ে প্রজ্বলিত রাখার উজ্জ্বল এক লোক-সংস্কৃতি।

এতে গ্রাম বাংলার মানুষের সাথে শহরবাসীর সমন্বয় ঘটে। বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরা রাজ্যে বৈশাখ মাসের প্রথম দিনে ঘটা করে নববর্ষ উৎসব পালিত হয়ে আসছে। বাংলার নববর্ষ উৎসব এখন বিশ্বব্যপী সর্বজনীন বাঙালির মাধুর্যময় লোক-উৎসব বিবেচিত হয়েছে। উৎসব তখন একমাত্র কৃষি নির্ভর অর্থনীতির সাথে যুক্ত। জমিদারদের পণ্য বা খাজনা বা রাজস্ব আদায় দোকানদার, মহাজনদের হালখাতা, সবেতেই অর্থনৈতিক হিসেব নিকেশই ছিল মূল উদ্দেশ্য। বাংলাদেশের বাংলা একাডেমী প্রতি বছর এপ্রিল মাসের ১৪ তারিখ নববর্ষ উৎসব পালনের দিন ধার্য করেছিল। সরকার এই দিনটিকে ছুটির দিন ঘোষণা করেন।১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দ (বাংলা ১৩৭৯ সন) ১লা বৈশাখ বাংলাদেশের জাতীয় উৎসবের অন্তর্ভুক্ত হয়। বাংলা সনের প্রবর্তক সম্পর্কে ঐতিহাসিকরা ভিন্ন মত পোষণ করলেও গরিষ্ঠ সংখ্যক ঐতিহাসিকের মতে ,সপ্তম শতকে বাংলার শাসক মহারাজ শশাঙ্ক ছিলেন সর্বপ্রথম ও মূল উদ্ভাবক। পরবর্তী সময়ে সমগ্র ভারতবর্ষে মোঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হলে ,খাজনা বা রাজস্ব আদায়ের সুবিধার জন্য সম্রাট আকবর বাংলা সনের সংস্কার করেন ।

সমগ্র ভারতবর্ষ তখন মোঘল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত। তাঁরা প্রজাদের থেকে খাজনা আদায় করত, তাঁদের হিজরি চান্দ্র সন অনুযায়ী। হিজরি চান্দ্র সন আইন হওয়ায় কৃষির সাথে সামঞ্জস্য হতনা। অসময়ে খাজনা বা রাজস্ব দিতে প্রজারা মহাসংকটে পড়তেন। সম্রাট আকবর সমস্ত বুঝে প্রাচীন বর্ষপঞ্জি সংস্কারের আদেশ দেন। জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও মননশীল ব্যক্তিত্ব ফতেহউল্লাহ সিরাজ সম্রাটের আদেশ মত সৌর সন ও আরবি চান্দ্র সনের সমন্বয়ে নতুন বাংলা সন নির্ণয় করেন। তা হল ৯৯৩ হিজরির রবিউল আওয়াল, ১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসের ১০ তারিখ থেকে গণনা শুরুর কথা। কিন্তু বাংলা সন কার্যকর হয়  বিশেষ একটি দিনকে স্মরণে রাখতে ৯৬৩ হিজরি বা ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ৫ই নভেম্বর সম্রাট আকবরের সিংহাসনে অভিষেকের দিন থেকে।

সেদিন ৯৬৩ হিজরি চান্দ্র সনকে ৯৬৩ সৌর সনে রূপান্তর করে বাংলা সনের যাত্রা শুরু হয়। এক থেকে বছর গণনা শুরু না হয়ে হয় ৯৬৩ থেকে। সেই অনুযায়ী বাংলা বর্ষপঞ্জির বয়স মাত্র ৪৬২ বছর। এই সনের প্রথম নামকরণ হয় ফসলি সন। পরবর্তী সময়ে বদল হয়ে বঙ্গাব্দ বা বাংলা সনে পরিচিত হয়। ফতেহউল্লাহ সিরাজের বাংলা সন নির্ধারণের মূল ভিত্তি ছিল হিন্দু সৌর পঞ্জিকা। তাঁর পঞ্জিকার নাম ছিল শক বর্ষপঞ্জিকা বা শকাব্দ। হিন্দু পঞ্জিকায় আগে থেকেই বাংলায় বারো মাসের নাম উল্লেখ ছিল। তাতে চৈত্র মাস ছিল বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস। ৯৬৩ হিজরি সনের প্রথম মাস মহরম। বাংলা সনে প্রথম মাস বৈশাখ মাস। তখন থেকেই বৈশাখ বছরের প্রথম মাস হিসেবে গণনা করা হয়। অর্থাৎ মোঘল আমল থেকেই বৈশাখ মাসের প্রথম দিনটিতে নববর্ষ উৎসব পালিত হয়ে আসছে।

প্রজাবৃন্দ চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যেই বাৎসরিক খাজনা মিটিয়ে দিতে বাধ্য হত। পরের দিন ১লা বৈশাখ। মোঘল সম্রাট এই বিশেষ দিনটিতে বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে নববর্ষ উৎসব পালন করতে সমস্ত জমিদারদের সাথে বিশেষ বিশেষ প্রজাদের আমন্ত্রিত করে মিষ্টিমুখ করাতেন। বাংলার ব্যবসায়ীগণ, দোকানদার ও মহাজনেরা লাল রঙের কাপড়ে মোড়ানো হালখাতায় আমন্ত্রিত অতিথির অর্থে খাতা সাহিত করতেন।দোকানের সামনে দুইধারে কলাগাছ বসিয়ে আম্রশাঁখা যুক্ত জলভর্তি দুটি মাটির কলসি মঙ্গল ঘট বসান। নির্দিষ্ট স্থানে সিদ্ধিদাতা গণেশ ও মা লক্ষ্মীর পূজা অর্চনা শেষে সকলকে মিষ্টিমুখ করাতেন। লাল কাপড়ে মোড়ানো খাতার উপরে লেখা থাকত “এলাহি ভরসা”।

এই শব্দটি এসেছে সম্রাট আকবরের দীন ই এলাহি বা তারিখ ই এলাহি শব্দ থেকে বলে ঐতিহাসিকগনের ধারণা। আধুনিক নববর্ষ উৎসব প্রথম পালিত হয় ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশদের সফলতা কামনা করে। সেবছর ১লা বৈশাখে হোম ,কীর্তন ও পূজার ব্যবস্থা করা হয়। সেই ধারাবাহিকতা আজও চলে আসছে। আজকের দিনে ১লা বৈশাখ জনপ্রিয় নববর্ষ উৎসব উদযাপনের প্রচলন হয়েছে মূলত এক রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আয়ুব খাঁ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জাতীয় সঙ্গীত পাকিস্তানে নিষিদ্ধ করেন।

বাঙালির সংস্কৃতি চর্চায় বিরোধিতা করার প্রতিবাদে দেশের মানুষ গর্জে ওঠেন। তারপর ‘ছায়া নট’ ১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দে (বাংলা ১৩৭২ সন) রমনার বটমূলে মঞ্চ গড়ে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের ‘এসো হে বৈশাখ এসো’ গানটি দিয়ে সর্বপ্রথম বর্ষবরণের  যাত্রা শুরু হয়। ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দে জাতিসংঘের অঙ্গসংগঠন ইউনেস্কো মনোগত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্বীকৃতি দেন। তবে বর্তমানে নবপ্রজন্মের তরুণ-তরুণীদের চোখে মুখে সে উন্মাদনার পরিপূর্ণ সাক্ষাৎ মেলে না। ইংরেজি নববর্ষের কাছে যেন পিছিয়ে পড়েছে বাংলা নববর্ষ।

Related Articles