সম্পাদকীয়

ব্রিটিশ আমলের সেই বাংলো

That bungalow from the British era

রাজু পারাল: তখন বয়স অল্প ছিল। তাই মনে সাহস আর শক্তি ছিল ভালই। যে কোন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে পিছপা হতাম না। এরকমই এক চালেঞ্জ নিতে গিয়ে ভারি বিপদে পরে গিয়েছিলাম। সে কথা বলতে গেলে এখনও ভয়ে বুক শুকিয়ে যায়। শুরু করি তাহলে। শীতের দুপুর। রঞ্জনদের বাগানে আড্ডা মারছিলাম আমরা চার বন্ধু। আমি, ভুতো, করুনা আর রঞ্জন। হটাৎ রঞ্জনই কথাটা পারলো যে ওদের কোলাঘাটের বাংলো বাড়িতে নাকি প্রেতাত্মা দেখা যায় মাঝে মধ্যে।

কথাটা শুনে আমি খুব জোরে হেসে উঠলাম। বেশ অবিশ্বাসের সুরে বলে উঠলাম ‘তাই নাকি’? রঞ্জন তাতে পাত্তা না দিয়ে বলতে লাগল, ওই বাড়িতে এক মহিলা গলায় দড়ি দিয়েছিল। তারপর থেকেই নাকি অনেকে দেখতে পেয়েছে ওই বাংলোতে অল্পবয়স্ক এক মহিলাকে ঘুরতে ফিরতে। বাড়িটা রঞ্জনের দাদু কিনেছিলেন এক ব্রিটিশ প্রতিনিধির কাছ থেকে। দাদু মারা যাবার পর বাড়িটার একটা অংশ রঞ্জনের বাবা ভাড়া দিয়ে দিয়েছিলেন। আর একটা অংশ নিজেরা থাকবার জন্য রেখেছিলেন।

রঞ্জনরা মাঝে মধ্যে ওই বাংলো বাড়িতে কয়েকদিন ছুটি কাটিয়ে আবার কলকাতায় ফিরে আসতো। সে সময়টায় এক ভদ্রলোক তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে রঞ্জনদের বাংলো বাড়িতে ভাড়া আসে। ভদ্রলোক আগে চাকরি সূত্রে দুর্গাপুরে থাকতেন। পরে কোলাঘাটে বদলি হওয়ায় শেষমেশ বাড়ি ভাড়া নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তখনই কাকতালীয় ভাবে রঞ্জনের বাবার সাথে যোগাযোগ হয়ে যায়। ভদ্রলোক বাড়িটা ভাড়া নেন। ভদ্রলোকের বয়স গোটা পঞ্চাশ আর ওর স্ত্রীর তিরিশ। বছর খানেক হল ওদের বিয়ে হয়েছে। নতুন সংসারে প্রথমটায় ওরা মানিয়ে চললেও দু’চার মাস যাবার পর চরম অশান্তি দেখা দিল ওদের মধ্যে। দিনের পর দিন অশান্তি এতটাই চরমে উঠল যে ওনার স্ত্রী সংসার থেকে মুক্তি পেতে আত্মহত্যা করেন শেষপর্যন্ত। ভদ্রলোকও আর ওই বাড়িতে থাকতে পারেন নি।

তিনি নাকি একাধিকবার ওই বাড়িতে মৃত স্ত্রীকে ঘোরা ফেরা করতে দেখেছেন। পরে আর একজন ভাড়াটে এলে তিনিও একই জিনিস দেখেন। কথাটা লোকমুখে ছড়িয়ে পড়লে রঞ্জনদের ওই বাংলো আর কেউ ভাড়া নিতে চাইল না। তখন থেকে ওই বাংলো তালা বন্ধ অবস্থাতেই পড়ে আছে। রঞ্জনরাও আর ওখানে যায় না বেশ অনেক বছর। এই পর্যন্ত শোনার পর দেখলাম সবাই বেশ চুপচাপ। কতক্ষন সময় কেটেছে জানি না।

সহসা আমিই নি:স্তব্দতা ভাঙলাম। রঞ্জনকে বললাম, ‘তোদের ওই বাংলোয় আমি গিয়ে দু’একদিন গিয়ে থাকবো।’ রঞ্জন বললো, ‘ক্ষেপেছিস’। সব শোনার পরও তুই কি করে বলিস যাবার কথা ? অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে রঞ্জন অবশ্য ওর বাবার অনুমতি পেয়েছিল শেষপর্যন্ত।

আমি একাই রওনা দিলাম রঞ্জনদের কোলাঘাটের বাড়ির উদ্দেশ্যে। সকাল দশটা নাগাদ বেড়িয়ে পড়লাম। ট্রেন লেট করায় পৌঁছতে পৌঁছতে দুপুর একটা বেজে গেল। জায়গাটা কোলাঘাট স্টেশন থেকে একটু ভিতরে। এদিক ওদিক ঘুরেঘারে একটা রিক্সা বাংলোটার সামনে নামাল। রিক্সাওয়ালা বলল – ‘বাবু, একটু সাবধানে থাকবেন। এই বাড়িটার একটা দুর্নাম আছে। এদিকটায় লোকজন বড় একটা আসে না। ‘কথাটা গ্রাহ্য না করে ওর ভাড়া মিটিয়ে এগিয়ে গেলাম।

পৌঁছলাম বিশাল এক বাংলোর সামনে। কি অপূর্ব বাংলোটা। হবে নাই বা কেন? ব্রিটিশ আমলে রঞ্জনের দাদু কিনেছিলেন। না, মানতে হবে রঞ্জনের দাদুর পছন্দ ছিল। দু’তলা বাংলোটা’র চারপাশে ঘন আগাছা জন্মে গেছে প্রচুর। অনেক বছর না আসার ফল যে এটা তা বোঝা যাচ্ছে। বেশ যত্ন করে বেড়ে উঠেছে আগাছাগুলো। বাংলোর দিকে তাকিয়ে দেখলাম দেওয়ালের অনেকাংশ পলেস্তার খসে গেছে। রং-ও বিবর্ণ হয়ে গেছে। ফাটলও ধরেছে বেশ কয়েক জায়গায়।

বাংলোর এক পাশে আছে পানীয় জলের টিউবওয়েল একটা। রঞ্জনের মুখে শুনেছি দিনের বেলা অনেক দূর থেকে স্থানীয় লোকজন আসে জল নিতে। যাইহোক, টাল বাহানা না করে বাক্স প্যাঁটরা বগলদাবা করে ঢুকলাম বাংলোর ভিতরে। একটা ভ্যাপসা গন্ধে গা গুলিয়ে উঠল। অনেক দিন ঘরগুলো পরিষ্কার না করায় ধুলো আর ঝুলও পড়েছে বেশ। দোতলার একটা ঘর পরিস্কার করে থাকার ব্যবস্থা করলাম। সঙ্গে আনা কিছু খাবার খেয়ে জানলার ধারে চেয়ারে বসে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইলাম। লোকমুখে শোনা গল্প কি সত্যি হতে পারে ? ভূতের ভয় আমার কোনোকালেই ছিল না। কাজেই সেদিক থেকে আমার কোনো অসুবিধা নেই। তবে চোর ডাকাতের একটা ভয় তো রয়েছে। আর তারাই বা কি নেবে। হাতঘড়ি, টর্চ আর সামান্য কিছু টাকা ছাড়া আর কিছুই তো নেই আমার কাছে। যাইহোক এসব ভেবে এখন কোনো লাভ নেই। শুধু একটু সাবধানে থাকতে হবে।

দু’দিন কেটে গেল ভালোয় ভালোয়। বাংলোয় অস্বাভাবিক কিছু চোখে পড়েনি এখনও পর্যন্ত। ক’দিন সকালের দিকে স্টেশন চত্বর থেকে দু’বেলার খাবার নিয়ে চলে আসতাম। সেদিনও তাই করলাম। দিনটা ছিল বুধবার। সকাল থেকেই মনটা কিরকম অন্যমনস্ক হয়ে আছে। খালি মনে হচ্ছে আজ রাত্রিতে কিছু একটা ঘটবে। কোনোরকমে রাত ন’টা অবধি কাটালাম বই পড়ে। একা থাকলে সময় কাটতে চায় না। ঠান্ডাটাও জমিয়ে পড়েছে। আপাদমস্তক চাদর জড়িয়ে বিছানায় বসে আছি। বাইরে রাতের নীলাভ কুয়াশা মাখা অন্ধকার। আজ কি অমাবস্যা? একফোঁটা আলো দেখা যায় না কেন? কেবল একরাশ ধোঁয়া ঘিরে রয়েছে চারদিক। হালকা বাতাসে কে যেন ফিস ফিস করে কিছু জানাতে চায়।

ভীষণ রহস্যময় সেই বার্তা। চমকে উঠলাম। নিস্তব্দ রাতের বুক চিরে আচমকা ভেসে এল নারীকণ্ঠের তীব্র কান্নার শব্দ। বিরাট বাংলোর দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে ফিরে ফিরে আসছে সেই কণ্ঠস্বর। বুঝিবা শত সহস্র বছরের যন্ত্রণা বুকে নিয়ে কেঁদে চলেছে কেউ। সে কান্নার বিরাম নেই কোনো। যেন কিছু বলতে চায় সে। এমন কিছু যা স্মৃতির অতলে তলিয়ে গেছে বহুদিন। মর্মভেদী হাহাকারে আমার সারা শরীরে যেন বিদ্যুৎ তরঙ্গ বয়ে গেল। অন্ধকারে বাংলোটাকে যেন মনে হতে লাগলো মৃত্যুপুরী। অন্ধকার করিডোর দিয়ে একতলার দিকে এগিয়ে চললাম। কান্নার আওয়াজটা ওদিক থেকেই আসছে। সাবধানী পা ফেলে সন্তপর্ণে এগিয়ে চললাম। আজ এই রহস্যের শেষ দেখেই ছাড়বো। একটা ঘরের দরজা হালকা ভেজানো।

আচমকা ঠেলতেই খুলে গেল। যা দেখলাম ভয়ে আমার সারা শরীর কাঁটা দিয়ে উঠলো। পা দুটো এমন অবশ হয়ে গেছে যে মনে হচ্ছে কেউ ধরে রেখেছে। দেখলাম একজন মহিলা গলায় দড়ি দিয়ে সিলিংএ ঝুলছে। তার চোখ দুটো যেন ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে। গলা থেকে জিভটা বেরিয়ে এসেছে প্রায় চার ইঞ্চি। কী ভয়াল, বিভৎস সেই চেহারা। যাবতীয় আক্রোশ যেন চোখে মুখে ঝরে পড়ছে। আবার তাকিয়ে আছে আমার দিকেই। বাপরে ! আর এখানে থাকে? প্রানপণে মারলুম দৌড়। কতক্ষন দৌড়ে ছিলাম জানি না। জ্ঞান যখন ফিরল দেখলুম বাংলো থেকে একটু দূরে রাস্তায় পড়ে আছি। স্থানীয় লোকেরাই আমার জ্ঞান ফিরিয়েছে। কৃতজ্ঞতা জানিয়ে ফিরে এলুম বাংলোয়। না, আর এক মূহুর্তও এখানে নয়। কলকাতায় ফেরতে হবে এখনই।

Related Articles