সম্পাদকীয়

সামাজিক অনুশাসন ও সামাজিক শৃঙ্খলা

Social discipline and social order

Truth of Bengal, কাজল ব্যানার্জি: প্রথমেই বলে রাখি আমি সমাজ-বিজ্ঞানের ছাত্র নই, গবেষকও নই। শুধুমাত্র পর্যবেক্ষণলব্ধ অভিজ্ঞতা থেকে আমার যেটুকু মনে হয়েছে, তা হল সামাজিক অনুশাসনে শৈথিল্যের কারণেই সমাজ আজ নিম্নগামী। ভোগবাদ, অর্থহীন-প্রতিযোগিতা, রাজনৈতিক মনোভাবের প্রাধান্য ও উগ্রতা, এককেন্দ্রীকতা ও স্বার্থপরতার মাসুল স্বরূপ সামাজিক মূল্যবোধ, নৈতিকতা আজ লুপ্তপ্রায়।

এবং নিশ্চিত ভাবেই বলা যায়, সামাজিক অনুশাসন ও সামাজিক শৃঙ্খলাকে ফেরাতে না পারলে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনও আমাদের জীবনে প্রকৃত পরিবর্তন আনতেই পারবে না। কারণ মানুষের সমষ্টিগত রূপই সমাজ! মানুষ নিজেকে পরিবর্তিত করতে না পারলে সমাজ পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা অর্থহীন। আমার ক্ষুদ্র অনুভবে, আমার ক্ষুদ্র চেতনায় সামাজিক অনুশাসন ও সামাজিক শৃঙ্খলা বলতে যেগুলি মনে হয়েছে, সেগুলি হল–

১. গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নিজের ভোট নির্বিঘ্নে নিজে দেওয়ার অধিকার।
২. নিজস্ব মতামত প্রকাশ বা বাক-স্বাধীনতার অধিকার।
৩. জাতীয় পতাকা, জাতীয় সম্পদ, জাতীয় সংহতি ইত্যাদির হানি বা মানহানির বিরুদ্ধে প্রত্যেক নাগরিকের রুখে দাঁড়ানোর অধিকার।
৪. নিজস্ব ইচ্ছা অনুযায়ী, তৃতীয় কোনও ব্যক্তিকে টাকা না দিয়ে, স্বাধীনভাবে জমি বা বৈধ-সম্পদ কেনাবেচার অধিকার।
৫. নিজের জমিতে তৃতীয় কোনও ব্যক্তি বা দলকে টাকা না দিয়ে বসত বাড়ি নির্মাণের অধিকার।
৬. সঙ্গত কারণে বয়জেষ্ঠ্যদের ছোটদের বকাঝকা ও সুপরামর্শ দেওয়ার সমাজ স্বীকৃত অধিকার।
৭. স্কুলে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের ছাত্রছাত্রীদের শাসন করার অধিকার।
৮. পরীক্ষায় টুকলিতে বাধা দেওয়া ও উপযুক্ত পদক্ষেপের অধিকার।
৯. পাশ না করা শিক্ষার্থীকে উচ্চ শ্রেণিতে উত্তীর্ণ না করার অধিকার।
১০. গলি রাস্তায় কেউ বেশি গতিতে গাড়ি চালালে তাকে নিষেধ করার অধিকার।
১১. কোনও ব্যক্তি নিজের জমির বেড়া বা পাঁচিল রাস্তার মধ্যে এগিয়ে আনলে তাঁকে বাধা দেওয়ার অধিকার।
১২. ব্যক্তি বিশেষের গাছপালা রাস্তায় বা বৈদ্যুতিক তারে পড়লে অন্যদের সেগুলি বলার অধিকার।
১৩. ডিজে, শব্দবাজি, অশ্লীল ক্রিয়াকলাপ ইত্যাদিতে নিষেধের অধিকার।
১৪. রাস্তায় পাকা ড্রেন না থাকা সত্ত্বেও বাড়ির পয়ঃপ্রণালির জল রাস্তায় পাঠানোর বিপক্ষে প্রতিবাদের অধিকার।
১৫. পরিবেশ দূষণ বা পরিবেশকে অপরিচ্ছন্ন করার বিপক্ষে বলার অধিকার।
১৬. যে কোনও নেশা করলে তাদের নিষেধ করার অধিকার।
১৭. দৃষ্টিকটু বিষয়গুলি সর্বসমক্ষে সম্পন্ন করার বিষয়ে নিষেধ করার অধিকার।
১৮.পাড়ায় মদের কারখানা বা মদের দোকানের বিরুদ্ধে বলার অধিকার।
১৯. অসামাজিক কাজকর্মের বিপক্ষে বলার অধিকার।
২০. নিষিদ্ধ সামগ্রী, বস্তু, বিষয়, ভিডিয়ো বা ছবি প্রচারকারীদের বিপক্ষে বলার অধিকার।
২১. বেআইনি নির্মাণ, বেআইনি ভরাটের বিপক্ষে বলার অধিকার, কর্তৃপক্ষের নজরে আনার অধিকার।
২২. চাঁদার নামে জোর-জুলুম, তোলাবাজির বিরুদ্ধে সরব হওয়ার অধিকার।
২৩. একই দ্রব্য বাজারে ভিন্ন ভিন্ন দোকানে ভিন্ন ভিন্ন দামে বিক্রয়ের বিপক্ষে বলার অধিকার।
২৪.স্ট্যান্ড থেকে যাত্রীর নিজের স্বাধীন পছন্দ (থাকলে) মাফিক ভ্যান, রিক্সা, টোটো বেছে নেওয়ার অধিকার।
২৫. স্থানীয় প্রশাসন কর্তৃক রাস্তা, নালা, কালভার্ট তৈরির সময় গুণগত মান বুঝে নেওয়ার অধিকার। লো-ভোল্টেজের বিরুদ্ধে বলার অধিকার।
২৬. সঙ্গতি থাকা সত্ত্বেও বাবা-মা কে না দেখলে সামাজিক ভাবে তার ওপর চাপ সৃষ্টি করার অধিকার।

ইত্যাদি নানা বিষয়ে সমাজিকা শৃঙ্খলা ঠিক রাখতে করণীয় বিষয়ে ব্যক্তির সামাজিক অধিকার সুনিশ্চিত না করতে পারলে সামাজিক বিকাশ অধরাই থেকে যাবে। পুলিশ, প্রশাসন, আইন-আদালত, রাজনৈতিক শক্তি দিয়ে সব কিছুর সমাধান সম্ভব নয়। একমাত্র সমষ্টিগত ভাবনাই আমাদের সঠিক এবং সুশৃঙ্খলিত সামাজিক জীবন উপহার দিতে পারে।
আসলে, বিষয়গুলি সবই স্থানীয় প্রশাসন সম্পর্কিত।

এসবের জন্য আর্থিক সংস্থানেরও বিশেষ প্রয়োজন হয় না। বিশ্বব্যাঙ্ক বা কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে ঋণ করারও প্রয়োজন হয় না। প্রয়োজন শুধুমাত্র নিরপেক্ষ ও রাজনীতিমুক্ত প্রশাসনিক ভাবনা নিয়ে শৃঙ্খলাভঙ্গকারীদের বিপক্ষে ও প্রতিবাদকারীদের পক্ষে থাকা। কিন্তু রাজনৈতিক স্বার্থে, সামাজিক শৃঙ্খলা ভঙ্গকারীদের প্রতি প্রশাসন নির্বিকার, উদাসীন থাকায় বেড়েই চলেছে এইসব সামাজিক অনাচার।

প্রশাসনের সকলের কাছে ভাল থাকার প্রয়াস, সকলের কাছে সমর্থন পাওয়ার প্রয়াসই কিন্তু সমাজকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। একটা সময় আমাদের রাজ্যে কিছুটা হলেও সামাজিক অনুশাসন ছিল (যদিও তাতে পক্ষপাতিত্ব ছিল), কিন্তু বর্তমানে তার লেশমাত্র দেখি না। তাই প্রতিনিয়তই আমি অনুভব করি, প্রশাসন পরিচালনার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলির উচিত ন্যূনতম সামাজিক শৃঙ্খলা রক্ষার দিকে নজর দেওয়া। অন্যথায় এই অধঃপতনের মাসুল কিন্তু তাঁদের পরিবারগুলিকেও একদিন দিতে হবে।