
Truth of Bengal, রাজু পারাল: স্মরণাতীত কাল থেকে নানা পথ পেরিয়ে বিদেশিরা এদেশে এসেছে, এ কথা নতুন নয়। ভারতের মাটিতে মানবতাবাদের সাধনা করেছিলেন যুগাবতার শ্রীরামকৃষ্ণ ও তাঁর শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দ। তাঁদের ধর্মীয় সাধনার উদার মহিমা বহু বিদেশিকে ভারতে টেনে এনেছিল এক অজানা আকর্ষণে।
সন্ন্যাসিনী, ধর্মপ্রাণা, শিক্ষাব্রতী, সেবাপরায়না, দেশপ্রেমী, বিপ্লবী নিবেদিতা ভারতে আগত এমনই একজন মহিয়সী নারী। তাঁর মধ্যে ভারতবাসী প্রত্যক্ষ করেছে মহাশক্তির অস্তিত্ব, জেনেছে তাঁর স্নেহ, মায়া, মমতার মধ্যেই লুকিয়ে আছে বিপুল শক্তি। নিবেদিতা ভারতে আসেন এক যুগসন্ধিক্ষণে, ভারত আত্মার পরিচয় লাভের একান্ত বাসনা নিয়ে। এদেশের মানুষের কাছে তাই তিনি হয়ে উঠেছিলেন চিরশ্রদ্ধেয়।
আচার্য স্বামী বিবেকানন্দের মানস কন্যা ভগিনী নিবেদিতার জীবন যেমন ভাব-গম্ভীর, তেমনই শিক্ষাপ্রদ। বিদেশিনী হয়েও তিনি ভারতমাতার আদরিনী কন্যা, সর্বত্যাগিনী, ব্রতধারিনী। পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সভ্যতায় গঠিত জীবন নিয়ে কেমন করে ভারতীয় সংস্কৃতির ছাঁচে নিজেকে নতুন করে গড়লেন এবং ভারতের নারী জাতির শিক্ষাবেদীমূলে কীভাবে নিজের সমগ্র শক্তি নিঃশেষে উজাড় করে দিয়েছিলেন, ভারতের ইতিহাসে তা স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ থাকার যোগ্য।
শিল্পীগুরু অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘জোড়াসাঁকোর ধারে’ পুস্তকে নিবেদিতার কথা বর্ণনা করেছেন, ‘‘ভারতবর্ষকে যাঁরা সত্যিই ভালোবেসেছিলেন তার মধ্যে নিবেদিতার স্থান সব চেয়ে বড়। বাগবাজারের ছোট্ট ঘরটিতে তিনি থাকতেন। আমরা মাঝে মাঝে যেতুম সেখানে। গলা থেকে পা পর্যন্ত নেমে গেছে সাদা ঘাগরা, গলায় ছোট্ট ছোট্ট রুদ্রাক্ষের এক ছড়া মালা, ঠিক যেন সাদা পাথরের গড়া তপস্বিনী মূর্তি একটি। …সে যে কি দেখলুম- কি ক’রে বোঝাই!’’
উত্তর আয়ারল্যান্ডের বিখ্যাত নোবেল পরিবারে ১৮৬৭ সালের ২৮ অক্টোবর জন্ম হয় মার্গারেট এলিজাবেথ নোবেলের। যিনি সকলের কাছে পরিচিত ‘ভগিনী নিবেদিতা’ রূপে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ তাঁকে বলেছিলেন ‘লোকমাতা’। তাঁর কথায়, ‘‘নিজেকে এমন করিয়া সম্পূর্ণ নিবেদন করিয়া দিবার আশ্চর্য শক্তি আর কোনও মানুষে প্রত্যক্ষ করি নাই। তিনি নিজেকে সম্পূর্ণভাবে ভারতবর্ষের জন্য দান করিয়াছিলেন, নিজের জন্য কিছুমাত্র হাতে রাখেন নাই। …জনসাধারণকে হৃদয় দান করা যে কত বড় সত্য জিনিস তাহা তাঁহাকে দেখিয়াই আমরা শিখিয়াছি।’’
বাল্য বয়সে মাতামহের বাড়িতে নিবেদিতা তাঁর স্কুল কলেজের পড়াশোনা শেষ করেন। বিদ্যালয়ের কঠোর নিয়ম শৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে তাঁর নৈতিক, মানসিক ও কর্মজীবন সুন্দরভাবে গড়ে ওঠে। ওই বয়সেই নিবেদিতা শিক্ষকতা এবং সমাজসেবায় নিজেকে উৎসর্গ করবেন বলে মনস্থির করেন। কারণ তিনি বুঝেছিলেন, শিক্ষা কেবল জাতীয়তাবোধ জাগাবে না, পরন্তু তা জাতিগঠনমূলকও হবে।
জাতীয়তাবোধকে কেন্দ্র করে শিক্ষা আরম্ভ হলে দেশকে অন্তর দিয়ে ভালবাসা ও সেবা করা সম্ভব। তিনি মনে প্রাণে অনুভব করেছিলেন, একটা জাতিকে বাঁচতে হলে , নারী ও পুরুষ উভয়ের সমবেত শিক্ষা ও শক্তির সাহায্যে তা সম্ভব। অজ্ঞতা ও কুসংস্কারে নিমগ্ন, বিধিনিষেধের নির্মম কশাঘাতে জর্জরিত মাতৃজাতি যেভাবে প্রাণহীন হয়ে আছে, সেই মাতৃজাতির প্রকৃত শিক্ষার ব্যবস্থা করতে না পারলে ভারত মাতার দ্বার উন্মুক্ত হবে না।
নিবেদিতা শিক্ষার প্রসার ঘটাতে প্রথমে তাই এক বোর্ডিং স্কুলে শুরু করলেন তাঁর শিক্ষিকার জীবন। যা ছিল তাঁর বাল্যকালের স্বপ্ন। সেখানে তিনি কিশোরী মেয়েদের পড়াতেন ইতিহাস ও সাহিত্য। বছর তিনেক পড়াবার পর কাজ নিয়েছিলেন অন্য এক অনাথ আশ্রমে। কিন্তু বেশিদিন থাকলেন না এখানে। কর্মের আরও বিস্তৃত ক্ষেত্র খুঁজতে গিয়ে তিনি ঘুরে বেড়ালেন চেস্টার, লিভারপুল, উইম্বলন্ডনে।
সে সময়েই আয়ারল্যান্ডের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সাহচর্য ও রাশিয়ার বিপ্লব কাহিনি তাঁর মনে দেশপ্রেমের সুপ্ত চেতনাকে জাগিয়ে তোলে। পরিচিতি লাভ করলেন শিক্ষিত ও সম্ভ্রান্ত সমাজের সঙ্গে। লন্ডনের ওয়েস্ট এন্ডের অভিজাত মহিলা লেডি ইসাবেল মার্গসনের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। ইসাবেলের বৈঠকখানাতেই স্বামীজির সঙ্গে নিবেদিতার প্রথম সাক্ষাৎ হয় ১৮৮৫ সালের ১৫ নভেম্বর। তারপর থেকে যেখানেই স্বামীজির বক্তৃতা হয়, সেখানেই উপস্থিত হন মার্গারেট নোবেল।
মার্গারেট তাঁর মনের যাবতীয় প্রশ্নের সমাধান খুঁজে পেলেন গৈরিক আলখাল্লা পরিহিত সেই হিন্দু সন্ন্যাসীর কাছে। স্বামীজির বিপুল ও বিরাট ব্যক্তিত্বের প্রভাবে মার্গারেট ভারতকে জানলেন এক মানব-তীর্থরূপে। স্বামীজির আহ্বানেই সাড়া দিয়ে মার্গারেট এলেন ভারতবর্ষে। দ্বিধা, দ্বন্দ্ব, সংশয় সরিয়ে রেখে বৃহত্তর কর্মের আহ্বান তাঁকে নিয়ে এল ভারতের মাটিতে। মার্গারেট নিজের মধ্যে মিলিয়ে ছিলেন পাশ্চাত্যের ঋজুতা ও যুক্তিবাদের সঙ্গে প্রাচ্যের আবেগকে।
মহামানবের সাগরতীর ভারতবর্ষের মানুষের জন্য নিজেকে নিবেদন করেছিলেন বলেই স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর নাম দেন ‘নিবেদিতা’। মা সারদামনি প্রথম দেখাতেই এই বিদেশিনীকে ‘আমার মেয়ে’ বলে সম্বোধন করেন। নিবেদিতা হলেন মা সারদার ‘খুকি’। বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসুর সহধর্মিনী অবলা বসুর চোখে ‘হৈমবতী উমা’।নিবেদিতার লক্ষ্য ছিল ভারতের সর্বাঙ্গীন অগ্রগতি।
বিজ্ঞানসাধক জগদীশচন্দ্র বসু তাঁর সাহায্যে ফ্রান্সের বিশ্ববিজ্ঞান সভায় মর্যাদার আসন লাভ করেন। কলকাতার ‘বসু বিজ্ঞান মন্দির’ নিবেদিতার প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় নির্মিত হয়। স্বামিজীর তিরোধানের পর ‘বিবেকানন্দ সোসাইটি’ প্রতিষ্ঠা করেন নিবেদিতা। ১৯১১ সালের ১৩ অক্টোবর দার্জিলিংয়ে জগদীশচন্দ্রের বাসভবনে নিবেদিতার মহাপ্রয়াণ ঘটে। জগৎ সভায় শ্রেষ্ঠ আসন পাওয়ার জন্য ভারতবাসী আবহমানকাল ধরে ভগিনী নিবেদিতার পুণ্য নামটি যে স্মরণ করবে তাতে কোনও সন্দেহ নেই।