সম্পাদকীয়

সত্যজিৎ রায়ের অনবদ্য সৃষ্টি: ফেলুদা ও শঙ্কু

Satyajit Ray's incomparable creations: Feluda and Shanku

Truth Of Bengal: রাজু পারাল: পূর্বপুরুষদের সাহিত্য ও চিত্রশিল্পকে অতিক্রম করে তিনি সৃষ্টি করেছিলেন অনন্য এক ধারার। সারা বিশ্বে পরিচিত হয়েছিলেন চিত্রনাট্যকার, পরিচালক, গীতিকার, শিল্প উপদেষ্টা ইত্যাদি নানা রূপে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরেই সত্যজিৎ রায়ই বাংলা সংস্কৃতির আন্তর্জাতিক পরিচয়। বাঙালির সৃষ্টি, বাঙালির কৃষ্টির অপরিমেয় গুণমান বুঝতে গেলে সত্যজিৎ রায়ের কর্মজীবনের বিস্তার আলোচনাযোগ্য।

সত্যজিৎ রায়ের প্রসঙ্গ এলেই সকলের মনে এসে যায় তাঁর সৃষ্ট দুটি অনবদ্য চরিত্রের। প্রথমটি ‘ফেলুদা’। পরেরটি ‘প্রোফেসর শঙ্কু’। একজন গোয়েন্দা, অন্যজন বিজ্ঞানী। আগাথা ক্রিস্টির এরকুল পোয়ারো, আর্থার কোনান ডয়েলের শার্লক হোমস, শরদিন্দুর ব্যোমকেশ এবং তাদের উত্তরসূরি হিসেবে ‘প্রদোষচন্দ্র মিত্র’ ওরফে ‘ফেলুদা’ সার্থক। বলতে গেলে, এই গোয়েন্দা চরিত্রটিকে সত্যজিৎ রায় এক উচ্চতম ও আন্তর্জাতিক মানে পৌঁছে দিয়েছেন। ফেলুদার কাহিনিগুলি এমন সরস আর ঘরোয়া যে, পড়তে পড়তে মনে হয়, এ যেন আমাদের খুব পরিচিত।

গল্প বলার ফাঁকে ফাঁকে নানান জ্ঞাতব্য বিষয় সত্যজিৎ রায় এমন সুন্দরভাবে পরিবেশন করেছেন যে পাঠকদের অজান্তেই সমৃদ্ধ হয় পাঠকদের জ্ঞানের ভাণ্ডার। ফেলুদার কাহিনিগুলিতে হত্যাকাণ্ড থাকলেও খুন-খারাপির মতো নৃশংসতা দেখা যায় না। তার মূল কারণ সত্যজিৎ রায় সর্বদা ছোটদের মানসিক প্রতিক্রিয়ার কথা ভেবে কাজ করতেন। প্রখর বুদ্ধি, চিন্তা শক্তির কৌশল ইত্যাদির প্রয়োগ করে জীবন-মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ফেলুদা কীভাবে রহস্যের উন্মোচন করেন সেটাই হল কাহিনির মূল বিষয়বস্তু।

তাঁর গল্পের বিন্যাস, বলার ভঙ্গি, পাঠকদের মুগ্ধ করে, তন্ময় করে। পাঠকরা কাহিনির সঙ্গে একাত্ম হয়ে পড়ে। পড়তে পড়তে হারিয়ে যায় গ্যাংটক, কাশী, জয়সলমীরের পথ ঘাট, মানুষ আর সেখানকার প্রাকৃতিক দৃশ্যের সঙ্গে। নিবিড় ভাবে পরিচিত হয়ে পরে সেখানকার ধুলোমাটির সঙ্গে। কাহিনির চমৎকার বুনোট, সহজ, সরস অথচ প্রাঞ্জল ভাষায় যে নিটোল গল্পটির উপহার দেন তিনি, তা যথার্থই সুখপাঠ্য হয়ে ওঠে শেষপর্যন্ত।

ফেলুদা ও শঙ্কু উভয়েরই প্রথম আবির্ভাব ‘সন্দেশ’ পত্রিকায়। ১৯৬৫ সাল থেকে ফেলুদার জয়যাত্রা শুরু। প্রারম্ভেই আলোড়ন তুলেছে এই গোয়েন্দা। সারা জীবনে পঁয়ষট্টিরও বেশি রহস্যের সমাধান করেছেন তিনি। অগাধ জ্ঞান ও পাণ্ডিত্যের অধিকারী ফেলুদা। ভূতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব, ইতিহাস, ভূগোল, গানবাজনা– সব বিষয়েই পর্যাপ্ত জ্ঞানের অধিকারী প্রদোষ মিত্তির ওরফে ‘ফেলুদার’।

ফেলুদা সিরিজের পুরো গল্পে ফেলুদাকে দেখা যায় বিশ্লেষণ ও পর্যবেক্ষণের ক্ষমতা বা মগজাস্ত্রের উপর ভর করে জটিল থেকে জটিলতর রহস্যের উন্মোচন করতে। নিজের দেশ ছাড়াও পৃথিবীর নানা দেশের শিল্প-সংস্কৃতি, ইতিহাস সম্পর্কে তাঁর জ্ঞান অপরিসীম। ভারতবর্ষের এমন কোনও জায়গা নেই, যেখানে তিনি যাননি। দার্জিলিং, কাশ্মীর, কেদারনাথ, শিমলা, রাজস্থান, বোম্বাই, পুরী থেকে শুরু করে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল ঘুরঘুটিয়া, গোসাঁইপুর ইত্যাদি জায়গায় তিনি ঘুরেছেন তদন্তের স্বার্থে। একাধিকবার গেছেন বিদেশেও।

যার মধ্যে রয়েছে কাঠমান্ডু, হংকং, লন্ডন ইত্যাদি। তাঁর কাছে রহস্যের সমাধান মানেই রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা, অ্যাডভেঞ্চারের আনন্দ। কখনও রহস্যের সমাধানে তাঁকে ছদ্মবেশ ধারণ করতে হয়েছে, কখনও চালাতে হয়েছে রিভলবার। উদ্ধার করতে হয়েছে প্রাচীন রত্নালঙ্কার, মূল্যবান পাথর, দুর্মূল্য মূর্তি, কোথাও প্রাচীন পুঁথির সংগ্রহ, কোথাও অ্যান্টিক, কোথাও বা দুষ্প্রাপ্য সব জিনিস। ওই সমস্ত সম্পদকে কেন্দ্র করেই ঘনীভূত হয়েছে রহস্য।

সত্যজিৎ রায়ের লেখা ‘বাদশাহী আংটি’ ও ‘গ্যাংটকে গণ্ডগোল’ উপন্যাস দুটি প্রথম আনন্দ পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত হয়। ‘শারদীয় দেশ’ পত্রিকাতেও তিনি নিয়মিত লিখতেন ফেলুদা’কে নিয়ে। বলতে গেলে ওই চরিত্রটাই তখন ‘দেশে’-র প্রধান আকর্ষণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা সিরিজের বইগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য– বাক্স রহস্য, জয় বাবা ফেলুনাথ, গোরস্থানে সাবধান, হত্যাপুরী, যত কাণ্ড কাঠমাণ্ডুতে, ছিন্নমস্তার অভিশাপ, সোনার কেল্লা, কৈলাসে কেলেঙ্কারি, দার্জিলিং জমজমাট, নয়ন রহস্য ইত্যাদি।

সত্যজিৎ রায়ের কল্পবিজ্ঞান সিরিজের আর এক চরিত্র প্রোফেসর ‘ত্রিলোকেশ্বর শঙ্কু’ ওরফে ‘শঙ্কু’। শঙ্কু একজন বিজ্ঞানী ও পেশায় অধ্যাপক। তিনি নির্লোভ, সৎ, মানবদরদি এবং নির্ভীক একজন মানুষ। জাত-পাত মানেন না। গরিবমানুষদের প্রতি তিনি বিশেষভাবে দরদি। অত্যাচারীদের প্রতি সহিংস। অধ্যাপনার পাশাপাশি আবিষ্কার করেন বিভিন্ন ধরনের জিনিস। আশ্চর্যজনকভাবে ফেলুদার মতো তিনিও অজানা রহস্যে জড়িয়ে পড়েন বার বার।

দেশে-বিদেশে যখনই বিজ্ঞানভিত্তিক গুরুতর কোনও সমস্যা দেখা দেয়, তখনই ডাক পড়ে প্রোফেসর শঙ্কুর। ফেলুদার মতো তিনিও রহস্য উন্মোচনে পারদর্শী। শঙ্কু পেশাদারি গোয়েন্দা না হয়েও মৃত্যুর মুখে ঝাঁপিয়ে পড়ে রহস্যের সমাধান করেছেন। ফেলুদার রহস্য উন্মোচনের মতোই প্রোফেসর শঙ্কুর রহস্য উন্মোচন রোমাঞ্চে পূর্ণ। সত্যজিতের ‘শঙ্কু’ চরিত্রটির আবির্ভাব ১৯৬১ সালে।

সত্যজিৎ রায়ের উল্লেখযোগ্য শঙ্কু সিরিজের গল্পগুলি– শঙ্কু ও আদিম মানুষ, মহাসংকটে শঙ্কু, তারিণী খুড়োর কীর্তিকলাপ, সাবাস প্রোফেসর শঙ্কু, প্রোফেসর শঙ্কুর কাণ্ডকারখানা ইত্যাদি। বলাবাহুল্য, ‘ফেলুদা’ ও ‘শঙ্কু’ চরিত্র দুটি সত্যজিৎ রায়ের বিশুদ্ধ বাঙালিয়ানায় মোড়া। একটু তলিয়ে ভাবলে দেখা যাবে ফেলুদা বা শঙ্কু আলাদা কেউ নয়, তাঁরা দু’জনেই সত্যজিৎ রায়ের অদৃশ্য সত্তা।

Related Articles