সম্পাদকীয়

বিজ্ঞান সাধনায় বাঙালি

Bengalis in the pursuit of science

Truth Of Bengal: রাজু পারাল:

‘বিজ্ঞানই বর্তমান জগতের উন্নতির

মাপকাঠি, বিজ্ঞানের অগ্রগতিতেই

সভ্যতার অগ্রগতি।’

-আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়

সভ্যতার সঙ্গে বিজ্ঞানের সম্পর্ক অতি ঘনিষ্ট। বিজ্ঞান ছাড়া সভ্যতার কথা কল্পনা করা যায় না। আধুনিক সভ্যতার চরম উন্নতির মুলে আছে বিজ্ঞানের অবদান। বিজ্ঞানই পারে মানুষের মনের সবরকম ভ্রান্ত সংস্কার, অন্ধবিশ্বাস, অলৌকিকতা, কুপ্রথা দূরে সরিয়ে দিয়ে প্রকৃত আলোয় নিয়ে আসতে। উপযুক্ত সুযোগ এবং পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারলে বাঙালি বিজ্ঞানীরা যে কত বেশি কৃতিত্বের পরিচয় দিতে পারেন সে প্রমাণ আমরা অতীতে পেয়েছি। ব্রিটিশ আমলে রাজা রামমোহন রায়ের প্রচেষ্টায় এদেশে পাশ্চাত্য বিজ্ঞান শিক্ষার সুযোগ আসে। তখন থেকেই শুরু হয় বাঙালির বিজ্ঞান চর্চায় আত্মনিয়োগ।

একসময় বাঙালির বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল এই যে, ‘বাঙালি ব্যবসা-বাণিজ্য বিমুখ, কোনওরূপ বিপজ্জনক বা অনিশ্চিত জীবনযাত্রার পরিবর্তে নিশ্চিন্তে গৃহসুখ ভোগ করাই তাহার জীবনের লক্ষ্য।’ বিজ্ঞান বিরুদ্ধ এই অভিযোগ বঙ্গসন্তানরা খণ্ডন করেছেন জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বিশ্বখ্যাতি অর্জন করে। বিজ্ঞান চর্চার ঐতিহ্যের সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই বিজ্ঞানীরা তৈরি করেছিলেন অত্যাধুনিক বহু সামগ্রী। বিজ্ঞান মানুষের দরদি বন্ধু— তাকে কল্যাণের পথে সম্প্রসারিত করতে আজ বিভিন্ন বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠান এবং ক্লাবগুলি এ বিষয়ে অগ্রণী হচ্ছে। চলছে বিজ্ঞান প্রদর্শনী, বিজ্ঞান মেলা, আলোচনা চক্র, পথ-পরিক্রমা ইত্যাদির আয়োজন।

পরাধীন ভারতবর্ষে যে সব বিজ্ঞানী বিভিন্ন শাখায় তাঁদের কৃতিত্বের পরিচয় দিয়ে অসাধারণ প্রতিভার পরিচয় দিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে পরিসংখ্যান বিদ্যায় প্রশান্তচন্দ্র মহালানবীশ, ফলিত বিজ্ঞানে রাধানাথ শিকদার, চিকিৎসা বিজ্ঞানে উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী, রাধাগোবিন্দ কর, নীলরতন সরকার, বিধানচন্দ্র রায়, সুবোধ মিত্র প্রমুখের নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে যেমন স্মরণীয়, তেমনই সুভাষ মুখোপাধ্যায় তাঁর সৃষ্ট ‘টেস্ট টিউব বেবি’ এবং বিভা চৌধুরি তাঁর ‘নভোরশ্মি’ গবেষণার জন্য বিখ্যাত।

ব্রিটিশ শাসিত ভারতে বাঙালির বিজ্ঞান চর্চায় সুযোগ করে দিয়েছিলেন ড: মহেন্দ্রলাল সরকার। তিনি ভারতের মেধাবী ছাত্রদের পাশ্চাত্য বিজ্ঞান শিক্ষার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য ১৮৭৬ সালের ২৯ জুলাই গড়ে তুললেন ‘ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অব সায়েন্স’। পণ্ডিত বিদ্যাসাগর ২৫০০ টাকা দান করেছিলেন ওই অ্যাসোসিয়েশন গড়তে। মহেন্দ্রলাল সরকার নিজেও দিয়েছিলেন এক হাজার টাকা। এছাড়া কোচবিহারের মহারাজও দিয়েছিলেন আর্থিক সহায়তা। বিজ্ঞান সভার জন্য আজীবন হন্যে হয়ে টাকা জোগাড়ের চেষ্টা করে গিয়েছেন মহেন্দ্রলাল। তবে বিজ্ঞানসভা আরও বিকশিত হয়েছিল মহেন্দ্রলাল সরকারের মৃত্যুর পর।

বাঙালি বিজ্ঞানীদের মধ্যে যিনি সর্বপ্রথম বিশ্বখ্যাতি পান তিনি আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে ছিল বেতার আবিষ্কার। যদিও আবিষ্কারকের মর্যাদা তিনি পাননি। আচার্য জগদীশ চন্দ্রের আর একটি অনবদ্য অবদান ‘বসু বিজ্ঞান মন্দির’। যেটি স্থাপিত হয় ১৯১৭ সালে, যদিও এর পরিকল্পনা শুরু হয়েছিল ১৮৯৮ সালে। ভারতের গৌরব ও জগতের কল্যাণ কামনায় তিনি এই বিজ্ঞান মন্দির উৎসর্গ করেছিলেন।

এই বিজ্ঞান মন্দির প্রতিষ্ঠার পিছনে তাঁর সহধর্মিনী অবলা বসু ও সিস্টার নিবেদিতার অবদানও ছিল উল্লেখনীয়। লন্ডনের রয়্যাল সোসাইটির ধাঁচে তিনি এই বিজ্ঞান চর্চার পীঠস্থানটি গড়ে তুলেছিলেন। আজও ‘বসুবিজ্ঞান মন্দির’ সারা ভারতের মধ্যে বিজ্ঞান সাধনার একটি বিশেষ পীঠস্থান হিসেবে এগিয়ে চলেছে। প্রতি বছর দেশ-বিদেশের নামকরা বিজ্ঞানীদের বক্তৃতার মাধ্যমে সাড়ম্বরে এর প্রতিষ্ঠা দিবস পালিত হয়। এই বিজ্ঞান মন্দিরে গবেষণা করে অনেক ভারতীয় বিজ্ঞানীরা সময়ে সময়ে নানারকমের স্বীকৃতি পেয়েছেন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই বিজ্ঞানীকে সম্মান জানিয়েছেন এক কবিতার মাধ্যমে—‘সত্যর মন্দিরে তুমি যে দীপ জ্বালিলে অনির্বাণ/তোমার দেবতা সাথে তোমারে করিল দীপ্যমান’।

পরাধীন দেশের যুবসমাজকে বেকারত্ব থেকে মুক্তি দিতে ও দেশে শিল্প সংস্থা গড়ে তুলে স্বনির্ভর হতে বিজ্ঞানী প্রফুল্ল চন্দ্রের অবদানও কম ছিল না। ১৯০১ সালে তিনি মাত্র ৮০০ টাকা পুঁজিকে সম্বল করে নিজের উদ্যোগে গড়ে তোলেন ‘বেঙ্গল কেমিক্যাল অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যাল ওয়ার্কস’। যেখানে তৈরি করতেন বাসকের সিরাপ, জোয়ানের সার, কুর্চির সার, কালমেঘের সার, ফিনাইল, ন্যাপথলিন, এটকিমস সিরাপ ইত্যাদি। ভাবলে বিস্ময় জাগে পরাধীন দেশে একক প্রচেষ্টায় ধীরে ধীরে কেমন ভাবে তিনি দেশের যুবকদের স্বনির্ভর করার জন্য শিল্প গড়ে তুলেছিলেন।

মাতৃভাষার মাধ্যমে বিজ্ঞান শিক্ষা এবং বিজ্ঞানকে জনকল্যাণমুখী করতে আর এক বঙ্গসন্তান প্রশংসার দাবি রাখেন, তিনি বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু। তাঁর প্রতিষ্ঠিত ‘ইন্ডিয়ান কেমিক্যাল ওয়ার্কস’ , বেঙ্গল কেমিক্যাল ওয়ার্কসে’র অনেক আগে প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান বিষয়ে প্রবন্ধ লেখায় অন্যদের উৎসাহ দেবার জন্য  সত্যেন্দ্রনাথ ‘জ্ঞান বিজ্ঞান’ পত্রিকা চালু করেন। বহুবছর আগে ওই পত্রিকা যে লক্ষ্য নিয়ে চালু করেছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু তা আজও ধারাবাহিকভাবে প্রতিমাসে প্রকাশিত হচ্ছে।

২৮ ফ্রেবুয়ারি দিনটি ভারতের সর্বত্র ‘জাতীয় বিজ্ঞান দিবস’ পালিত হয়। প্রথম ‘জাতীয় বিজ্ঞান দিবস’ পালিত হয় ১৯৮৭ সালে। যাঁকে স্মরণ করে এই দিবস পালিত হয় তিনি আমাদের গর্বের বিজ্ঞানী সিভি রমন। ১৯২৮ সালে আলোর বিচ্চুরণের ওপর (রমণ এফেক্ট) গবেষণা করে নোবেল পান এই কৃতী বিজ্ঞানী। একথা অনস্বীকার্য আগামী দিনে বিজ্ঞানের প্রচার প্রসার করলে কেবল চলবে না, সাধারণ লোকেদেরও বিজ্ঞান চর্চায় আগ্রহী ও উৎসাহিত হতে হবে। উপরে উল্লেখিত বিজ্ঞানীদের জীবন ও কর্মসাধনা আমাদের আগামী দিনের পাথেয়।

Related Articles