সম্পাদকীয়

শিল্পগোষ্ঠীই কি তাহলে রাজনীতির ‘নিয়ন্ত্রক’?

Are industrial groups the 'controllers' of politics

Truth of Bengal, সুমন ভট্টাচার্য: এনসিপিকে বিজেপির দিকে টানতে গৌতম আদানির বাড়িতেই নৈশভোজের আয়োজন করা হয়েছিল। অজিত পাওয়ার এই তথ্য যখন ফাঁস করলেন, তখন শুধু মহারাষ্ট্রের বিধানসভা নির্বাচন চলছে না, গোটা পৃথিবী আলোড়িত আমেরিকার নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর ‘ধনকুবের’ এলন মাস্ক কতটা ক্ষমতাশালী হয়ে উঠেছেন, সেই বিতর্কে। কারণ, এবারের আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে জিতিয়ে আনতে পৃথিবীর সবচেয়ে ‘ধনীতম ব্যক্তি’ এলন মাস্ক যত ডলার খরচ করেছেন, যতটা উদ্যমী হয়েছেন, তত এর আগে কখনও দেখা যায়নি।

এবং নতুন প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর ডোনাল্ড ট্রাম্পও এলন মাস্ককে যথাযোগ্য জায়গা দিয়েছেন। শুধু যে মার্কিন আমলাতন্ত্রকে ‘ছেঁটে ফেলতে’, আক্ষরিক অর্থে ‘নিয়ন্ত্রণ করতে’ তিনি পৃথিবীর সবচেয়ে ‘ধনীতম ব্যক্তি’ এবং বিবেক রামস্বামীকে নিয়ে নতুন দফতর তৈরি করেছেন তা নয়, কার্যত দেখা যাচ্ছে নতুন মার্কিন প্রেসিডেন্টের ‘ছায়াসঙ্গী’ হয়ে উঠেছেন টেসলার মালিক এলন মাস্ক।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের নাতি রসিকতা করে বলেইছেন, ‘উনি তো আমাদের নতুন খুড়ো।’ ট্রাম্প পরিবারের যে-কোনও ছবির ফ্রেমে এলন মাস্ককে দেখা যাচ্ছেই। এমনকি ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন আন্তর্জাতিক রাজনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির সঙ্গেও কথা বলছেন, তখনও সেই ‘ফোন কল’-এ এলন মাস্ক ছিলেন বলে জানা যাচ্ছে। প্রশ্নটা ওঠা স্বাভাবিক, তাহলে কি রাজনীতিতে আর শিল্পগোষ্ঠীরা শুধু পিছন থেকে মদত নয়, তারাই সরাসরি ‘নিয়ন্ত্রক’ হয়ে দাঁড়াল? আর এই প্রশ্ন নিয়ে যখন তোলপাড় গোটা বিশ্ব, তখনই অজিত পাওয়ার, শরদ পাওয়ারের ভাইপো বলে দিলেন ২০১৯-এ এনসিপিকে কাছে টানার জন্য বিজেপি যে বৈঠকের আয়োজন করেছিল, তা হয়েছিল দিল্লিতে গৌতম আদানির বাড়িতে।

রাজনীতিতে রাজনীতিকের সঙ্গে বা রাজনৈতিক দলের সঙ্গে শিল্পপতিদের যোগাযোগ থাকবে এটা অস্বাভাবিক নয়। এখনও মনে আছে ২০০৬ সালে পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্টের বিরাট বিজয়ের পর আলিমুদ্দিন স্ট্রিট থেকে যে দুজন বুর্জোয়া ব্যবসায়ী লাল রঙের আবির মেখে বেরিয়ে এসেছিলেন, তাঁরা নিজেদের ‘সিপিএমের দলীয় সদস্য’ বলে দাবি করেছিলেন। এটা আলাদা প্রশ্ন যে, সেই দুই ব্যবসায়ীই পরে শিবির বদলেছেন, আর শিবির বদলানোর আগে একজনই জ্যোতি বসুকে ইজরায়েল নিয়ে গিয়েছিলেন। অর্থাৎ বামেদের চিরকালের ‘প্যালেস্টাইন ঘেঁষা নীতি’ থেকে এই যে সিপিএম আস্তে আস্তে ‘ইজরায়েল ভক্ত’ হয়ে পড়ল, তার পিছনে ওই রিয়াল এস্টেট শিল্পগোষ্ঠীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।

কিন্তু এগুলো সবই পিছন থেকে মদত। সরাসরি শিল্পপতির বাড়িতে বসে বিপক্ষের দল ভাঙানোর কৌশল বা বিপক্ষের রাজনীতিকদের ইডি-সিবিআইয়ের ভয় দেখানো, এটাই কি তাহলে ভারতীয় রাজনীতির ‘দস্তুর’ হয়ে দাঁড়াল? শরদ পাওয়ার বলেছেন, যেহেতু তাঁর দলের একাধিক নেতামন্ত্রীর বিরুদ্ধে সিবিআই-ইডির তদন্ত চলছিল, তাই তিনি দিল্লিতে গৌতম আদানির বাড়িতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহের সঙ্গে বৈঠকে বসেছিলেন কীভাবে বিষয়টির সমাধান করা যায়! তাহলে কি ধরে নিতে হবে যে, এবার থেকে শিল্পপতিরাই ঠিক করে দেবে ভারতবর্ষে কোন রাজনৈতিক দল থাকবে অথবা কোন রাজনৈতিক দল থাকবে না, কারা কার সঙ্গে জোট করবে বা কারা কার সঙ্গে জোট করবে না? গৌতম আদানি অথবা এলন মাস্ক কি ঠিক করে দেবেন রাজনীতির সব কিছু? বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী গণতন্ত্র, আমেরিকায়, আর সবচেয়ে বড় গণতন্ত্রে, অর্থাৎ ভারতে এই প্রবণতা দেখা গেলে রাজনীতি কোন দিকে যাচ্ছে, তা নিয়ে তুমুল বিতর্ক হবেই।

খুব সঠিকভাবেই কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী, যিনি শিল্পপতিদের সঙ্গ এড়িয়ে নিজের রাজনৈতিক ভাবমূর্তি তৈরি করার চেষ্টা করছেন এবং আমজনতার কথা বলার চেষ্টা করছেন, তিনি একেবারে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন শরদ পাওয়ার এবং তাঁর পরে অজিত পাওয়ারের এই ‘স্বীকারোক্তি’ নিয়ে। স্পষ্টতই তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, কেন আদানিদের এই ‘ইনভলভমেন্ট’ বা সম্পর্ক রাখা? তাহলে কি আদানিদের অর্থেই বিজেপি গত দশ বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে ভারতবর্ষের বিরোধী দলগুলিকে ভেঙেছেন এবং ভেঙে নিজেদের রাজনৈতিক আধিপত্য কায়েম করতে চেয়েছে? ভারতবর্ষের রাজনীতি এখনও ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমেরিকার মতো হয়ে যায়নি, তাই হয়তো রাহুল গান্ধী এই প্রশ্নগুলি করতে পারছেন।

কিন্তু আমেরিকার রাজনীতিতে এখন থেকে এলন মাস্ক বা তাঁর মতো ‘ধনকুবের’রা কতটা ছড়ি ঘোরাবেন, সেই নিয়ে ইতিমধ্যেই প্রশ্ন উঠে গিয়েছে। এবং প্রশ্ন ওঠার কারণ আমেরিকার ‘প্রগতিশীল’দের এলন মাস্কের অর্থ এবং তাঁর উদ্যোগের কাছে অসহায়ভাবে আত্মসমর্পণ। যে আমেরিকার তথাকথিত তথ্য প্রযুক্তি সংস্থাগুলি নাকি ‘প্রগতিশীল’দের ‘আঁতুড়ঘর’ ছিল, যেখান থেকে নাকি ‘প্রতিবাদের আগুন’ উথলে উঠত, সেই তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থাগুলিকে এলন মাস্ক দাঁড় করিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘অনুগ্রহ প্রার্থী’ হিসেবে। আর মাঝে যোগাযোগের ‘আড়কাঠি’ তিনি।

শিল্পপতিরা নিজেদের ভূমিকা শুধুমাত্র আর রাজনীতিতে চাঁদা দেওয়া অথবা চাঁদার বিনিময়ে ‘অনুগ্রহ’ পাওয়াতে সীমাবদ্ধ রাখবে না, এটা প্রথম দেখিয়ে দিয়েছিলেন থাইল্যান্ডের ‘টেলিকম জার’, থাকসিন সিনাবত্রা। যিনি থাইল্যান্ডে মোবাইল এবং টেলিকম জার হিসেবে পরিচিত হয়েছিলেন, তিনি যে আচমকা রাজনৈতিক দল খুলে অন্য সবাইকে চ্যালেঞ্জ করে একেবারে সরাসরি নিজে প্রধানমন্ত্রীর কুর্সিতে বসে যাবেন, তা কেউ জানত না। থাকসিন সিনাবত্রা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাজনীতিতে একটা ‘ফেনোমেনন’ বা ঘটনা। এবং তাঁকে যে কিছুতেই নস্যাৎ করা যাবে না, সেটা তিনি বারবার প্রমাণ করেছেন। যতবার থাইল্যান্ডের অন্য রাজনৈতিক দলগুলি বা রাজশক্তি তাঁকে বাতিল করে দেওয়ার চেষ্টা করেছে, তিনি কোনও না কোনও উপায়ে, কখনও তিনি নিজের বোনকে দিয়ে নতুন দল তৈরি করে, কখনও আবার নিজের মেয়েকে ফিরিয়ে এনে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করেছেন, সেটা আমাদের ভুলে গেলে চলবে না।

থাকসিন সিনাবত্রার ‘মডেল’ অবশ্যই এশিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে ব্যবসায়ীদের সামনে নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছিল। নিশ্চয়ই ব্যবসায়ীরা ভাবতে শুরু করেছিলেন যে, তাহলে আমরা শুধু চাঁদা দেব কেন? ‘বণিকের মানদণ্ড’ এবার ‘রাজদণ্ড’ রূপেই দেখা দিক। ঠিক যেমন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতবর্ষে ব্যবসা করতে এসে শাসকে পরিণত হয়েছিল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভারতবর্ষের শাসনভার হাতে নেওয়ার ঘটনা প্রায় ২৫০ বছর আগের। কিন্তু ‘বুর্জোয়া গণতন্ত্র’-এর যুগে যে পয়সাই শেষ কথা বলবে, ডলারই ঠিক করে দেবে ভোট কোন দিকে যাবে, তা আবার দেখালেন এলন মাস্ক। আর ঠিক সেই সময়ই এলন মাস্ক যখন নিজের লম্বা ছায়াকে আরও, আরও দীর্ঘায়িত করছেন, তখন ভারতবর্ষে গৌতম আদানিদের গুরুত্বকে একেবারে খোলা হাটে ভেঙে দিলেন শরদ পাওয়ারের ভ্রাতুষ্পুত্র, অজিত পাওয়ার।

মার্কিন নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয় প্রমাণ করে দিয়েছে তথাকথিত গণতান্ত্রিক চেতনা বা তথাকথিত সংঘবদ্ধ শ্রমিক আন্দোলন বা আরও যা যা কিছু ‘প্রগতিশীল’ শব্দকে আমরা চিনতাম, সেগুলোকে নস্যাৎ করে দিতে পারে এলন মাস্কের বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার অথবা তাঁর তথ্যপ্রযুক্তির সাহায্য নেওয়ার ক্ষমতা। তিনি যে মার্কিন নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে জেতাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছেন সেটা অনস্বীকার্য এবং ভোটে জেতার পর তাঁকে যে বিভিন্নভাবে নতুন রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট পুরস্কৃত করবার চেষ্টা করছেন, সেটাও প্রমাণিত সত্য। তাহলে কি ধরে নিতে হবে যেটা আমেরিকায় হচ্ছে সেটাই গত দশ বছর ধরে ভারতবর্ষে হয়েছে? আদানিরা শুধু নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহদের নির্বাচনে জিততে অর্থ দেননি, বিপক্ষের দল ভাঙতে, বিপক্ষের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের বাড়িতে ডেকে এনে ‘ভয় দেখাতে’ সাহায্য করেছেন।

সেইজন্যেই আদানিদের হাতে গিয়েছে বিমানবন্দর, সমুদ্রবন্দর বা আরও সব অন্য ব্যবসা, যাতে আদানিরা ফুলে ফেঁপে লাল হয়ে উঠেছেন। তাঁদের বিরুদ্ধে শেয়ার বাজারে জালিয়াতির অভিযোগ এলেও নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহরা চুপ করে থেকেছেন? তাহলে কি বৃহৎ ধনতন্ত্র এবং ব্যবসায়ীদের হাতেই চলে যাচ্ছে গণতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ? বোধহয় এলন মাস্কের ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠা আর গৌতম আদানির মহারাষ্ট্রের নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে চাওয়াটা এক সুতোয় বাঁধা। আমেরিকা পারেনি। আমেরিকা অনেক কিছু পারে না। আমেরিকা কোনও মহিলাকে শীর্ষাসনে বসাতে পারে না। কিন্তু ভারতবর্ষের জনতা কি আত্মসমর্পণ করবে আর আমাদের সংসদীয় গণতন্ত্র ব্যবস্থা চলে যাবে সরাসরি শিল্পপতিদের নিয়ন্ত্রণে? নাকি প্রতিরোধ করবে? রাহুল গান্ধী যেভাবে বলেছেন যে, আমজনতাই ঠিক করবে ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজম’ জিতবে না সাধারণ মানুষই সরকারের ‘নিয়ন্ত্রক’ থাকবে?

Related Articles