
Truth Of Bengal: রুদ্র সান্যাল: প্রাক শারদীয়ার মুহূর্তে যখন মহালয়ার ভোরে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠে দেবীর আগমনী বার্তা শুনি, তখন আমার মনেও এক অন্যরকম অনুভূতি জাগ্রত হয়। সেই কণ্ঠস্বরের মাধুর্য আর আবেগ আমাকে আমাদের সংস্কৃতির গভীরে নিয়ে যায় একই সাথে নিজেকে বাঙালি পরিচয়ের গর্বে গর্বিত করে।
কিন্তু একটা প্রশ্ন এসেই যায়, সেই চর্যাপদের যুগ থেকে বর্তমান পর্যন্ত বাঙালি সমাজের বিবর্তন আমাদের প্রকৃত বাঙালি ভাবতে শিখিয়েছে কি না, তা নিয়ে গভীর বিশ্লেষণ প্রয়োজন। চর্যাপদ বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন এবং বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ঐতিহ্যের ভিত্তি চর্যাপদে থাকা সহজিয়া দর্শন, জীবন এবং সমাজের বাস্তব চিত্র প্রতিফলিত হয়, যা তখনকার বাঙালি সমাজের গভীর জীবনবোধ তুলে ধরে।
বিংশ শতাব্দীতে বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা আন্দোলন এবং মুক্তি যুদ্ধের সময় বাঙালি জাতি সত্তা একটা নতুন পরিচয় আবির্ভূত হয়। এ সময় বাঙালি জাতির স্বাধীনতা এবং নিজস্ব সংস্কৃতির জন্য যে ত্যাগ ও সংগ্রাম তা আমাদের বাঙালি জাতিসত্তাকে পুনরায় জাগিয়ে তোলে। ব্রিটিশ ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে বাঙালির আত্মবলিদান চিরস্মরণীয় করে রেখেছে ইতিহাসকে। আমার বাঙালিয়ানা আমার বাঙালিত্ব আমার ঐতিহ্যের পরিচয়।
তবে প্রকৃত বাঙালি ভাবতে শেখানো মানে কেবল আমাদের ঐতিহ্যকে সম্মান করা নয়, বরং আমাদের বর্তমান এবং ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জগুলোকেও গ্রহণ করা এবং সেগুলোর মোকাবিলা করা। বাঙালি পরিচয় একটি চলমান প্রক্রিয়া, যা আমাদের জীবন এবং সমাজের প্রতিটা স্তরে প্রতিফলিত হয়।
আমাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের গভীরতাও আমাদের গর্বিত করে। দুর্গাপূজা, পয়লা বৈশাখ, এবং একুশে ফেব্রুয়ারির মতো উৎসব আমাদের ঐক্য ও সম্প্রীতির প্রতীক। এসব উৎসব আমাদের বাঙালি পরিচয়কে দৃঢ় করে।
একই সাথে বলতে ইচ্ছে হয়, আমরা হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি শেখ মুজিবুর রহমান, নেতাজি সুভাষ, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন এদের দেখেই রাজনৈতিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বাঙালি নিজেকে বাঙালি ভাবতে শিখেছে। সাহিত্যের মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ আর নজরুল ধর্মনিরপেক্ষতার সহজপাঠ আমাদের অন্তরে এবং মর্মে প্রবেশ করিয়ে দিয়েছিলেন। দুই বাংলার জাতীয় সঙ্গীতে অবদান তো কবিগুরুই। যদিও বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হয়, আমরা বাঙালিরা কি আত্মঘাতী জাতি হিসেবে নিজেকে তৈরি করে ফেলছি? বাঙালি তার নিজের কারণেই কি নিজেদের আত্মধ্বংসের দিকে এগিয়ে চলেছে দ্রুততার সাথে?
হাজার বছর ধরে যা আমরা অর্জন করেছি, তা কি শুধু মাত্র হিন্দু-মুসলমান করেই বিনষ্ট করে ফেলব। বাঙালি জাতিসত্তা কি এখন প্রশ্নের মুখে চলে এসেছে? প্রশ্ন তো উঠছেই। আমরা বাঙালি, আত্মসম্মানে গর্বিত জাতি থেকে নিজেদের নিছক রাজনৈতিক পরিচয়ে আর সাম্প্রদায়িক চেতনায় আত্মলুণ্ঠিত করে ফেলছি না তো? অনেক প্রশ্ন জেগে ওঠে। এখানে তাই আবার প্রশ্ন ওঠে, কেন আমি বাঙালি? যে বাঙালির মেধাকে সারা বিশ্ব শ্রদ্ধা করত, সেই শ্রদ্ধা কি এখন আত্মদোষে নিম্নগামী? তবুও দিনের শেষে একটাই কথা বলার, নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও গর্জে উঠে বলব, আমি বাঙালি, আর এটাই আমার অহংকার।
(সৌজন্যে – কণ্ঠস্বর)