ভ্রমণরাজ্যের খবর

ভারতে প্রথম চিনা বসতি গড়ে উঠেছিল বাংলায়! কোথায় জানেন?

The first Chinese settlement in India was established in Bengal! Do you know where?

Truth Of Bengal: সালটা ছিল ১৭৭৮। চিনে তখন প্রবল অর্থসঙ্কট চলছে। চিনের ব্যবসায়ীরা ভাগ্য ফেরাতে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েন। টং অছু নামে তেমনই এক চিনা ব্যবসায়ী  সমুদ্রপথ পেরিয়ে ঢুকে পড়েন কাটি গঙ্গার ভেতরে। অধুনা দক্ষিণ ২৪ পরগনার বজবজ থেকে কয়েক কিলোমিটার দক্ষিণে বজবজের পূজালির রাজীবপুর গ্রামে গঙ্গার ঘাটে বাণিজ্যতরী নোঙর করেন টং অছু।

জায়গাটির আগের নাম ছিল বালিয়া। অচেনা আগন্তুকের বাণিজ্যতরী দেখে তৎকালীন জমিদারমশাই আটক করার নির্দেশ দেন। বাণিজ্যতরী থেকে নেমে এসে জমিদারের নায়েবকে টং অছু জানান তিনি সবার জন্য চা নিয়ে এসেছেন। জমিদারের বাহিনী এমন কথা শুনে থ! চা আবার কী রকম বস্তু। সবাইকে চা বানিয়ে খাওয়ান টং অছু। চায়ের মতো অদ্ভুত পানীয় খেয়ে সবাই আপ্লুত হন। সবার মন জিতে নেন টং।

ধীরে ধীরে এই বঙ্গে চায়ের ব্যবসা শুরু করেন এই চিনা ব্যবসায়ী। ব্যবসা ধীরে ধীরে অনেক বড় হয়ে ওঠে। তার পরিচিতি ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন মহলে। এমনকি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গেও  সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে তাঁর। লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংস ছিলেন বাংলার প্রথম গভর্নর জেনারেল যিনি ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনে ঔপনিবেশিক শাসনের গুরুত্বপূর্ণ একজন ব্যক্তি ছিলেন।

তিনি ১৭৭২ থেকে ১৭৮৫ সাল পর্যন্ত এই পদে দায়িত্ব পালন করেন। শোনা যায়, লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংসও টং অছুর আনা চায়ের স্বাদ পান। টং অছুর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছিল ওয়ারেন হেস্টিংসের। টং অছু চিঠি দিয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির গভর্নরের কাছে ভারতে ব্যবসা করার অনুমতি চেয়েছিলেন। সেই অনুমতি মেলার পর এই ব্যবসা শুরু করেছিলেন তিনি। বার্ষিক ৪৫ টাকার বিনিময়ে ৬৫০ একর জমি প্রদান করা হয় চিনের এই ব্যবসায়ীকে।

টং অছু দেশে ফিরে ফের ভারতে আসেন। সঙ্গে নিয়ে আসেন শতাধিক চিনা শ্রমিককে। বালিয়ার চড়া মাদরি এলাকায় নামেন ও চিনির কল তৈরি করেন সেখানে। ধীরে ধীরে জনবসতি গড়ে ওঠে ওই এলাকায়। ঐতিহাসিকদের মতে এটিই ভারতে গড়ে ওঠা প্রথম চিনা বসতি। তবে তার আগেই চিনারা ভারতে এসেছেন। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে তারা আফিমের ব্যবসা করেছেন।আফিমের ব্যবসা করতে চিনারা প্রথম ভারতে এলেও জনবসতি গড়ে ওঠেনি আগে।

বালিয়াতে চিনারা আখের চাষ শুরু করে। নিজেদের সংস্কৃতি, সামাজিকতা, উৎসব পালন করা শুরু করে চিনারা। শুরু হয় ভারতে চিনির উৎপাদন। এর আগে ভারতীয়রা চিনি কী জিনিস জানত না। এছাড়া কলকাতার রাস্তায় বিত্তবান ধনীরাই গাড়ি চড়ে যাতায়াত করতেন। জুড়িগাড়িতে চড়ার কথা সাধারণ মানুষ কখনও ভাবতে পারত না। টং অছু জনসাধারণের কথা ভেবে ও কিছু গরিব মানুষের রোজগারের কথা ভেবে প্রথম টানা রিকশার প্রবর্তন করেন। ইতিহাস গবেষকরা মনে করেন, টং অছুর হাত ধরেই কলকাতার রাস্তায় প্রথম হাতে টানা রিকশার প্রচলন শুরু হয়।

টং অছু কিন্তু আর চিনে ফিরে যাননি। উনি ভারতেই রয়ে যান। সারাজীবন অকৃতদার ছিলেন টং। ওঁর দেখাশোনা করতেন টেলিবিবি নামে এক মুসলমান মহিলা। মৃত্যুর পর টং অছুকে সমাধিস্থ করা হয় চিনি কলের জমিতে। টং-এর স্মৃতিবিজড়িত বজবজের সেই জায়গা আজ অছিপুর বা স্থানীয়দের কথায় আছিপুর হিসাবে পরিচিত।

যে জায়গায় টং অছু ও বাকি চিনারা নেমেছিলেন সেটি আজ চিনেম্যানতলা বা চিনেকুঠিতলা হিসাবে পরিচিত। প্রতি বছর ১২-২৪ ফেব্রুয়ারি চিনা নববর্ষ হিসাবে এখানে জাঁকজমকপূর্ণ উৎসব হয়। দেশবিদেশ থেকে চিনারা আসে। চিনেম্যানতলার প্রধান দ্রষ্টব্য ‘পাকুমপাহ’র মন্দির। মন্দিরের বিগ্রহকে স্থানীয় বাসিন্দারা ‘খোদা খুদি’ নামে ডাকেন। মন্দির টং অছুই নির্মাণ করেন। টং অছু যখন এখানে আসেন তখন জায়গাটি সুন্দরবন অঞ্চলের অন্তর্গত ছিল। বাঘের উপদ্রব ছিল।

দক্ষিণরায় বা রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারকে তুষ্ট করতে দক্ষিণরায়ের মন্দির তৈরি করেন টং অছু। মন্দিরে ঘটকেই দেবীজ্ঞানে পুজো করা হয়। পরে নিজের আরাধ্য চিনা দেবী পাকুমপাহ’র মন্দির তৈরি করেন টং অছু। মন্দিরের গর্ভগৃহ ছোট্ট হলেও সাজানোগোছানো। মন্দিরের সামনে রয়েছে প্রার্থনাকক্ষ রয়েছে। মন্দিরের আরেকদিকে চিনা দেবতা কনফুসিয়াসের মন্দির রয়েছে। পুরো মন্দিরচত্বর গাছগাছালি ছাওয়া। মন্দিরের অদূরে রয়েছে গঙ্গা। নদী এখানে চওড়া। উল্টো দিকে হাওড়ার উলুবেড়িয়া। গঙ্গার পাড় ধরে কিছুটা এগোলেই অছু সাহেবের সমাধিস্থল।

কীভাবে যাবেন?

শিয়ালদহ দক্ষিণ শাখায় বজবজ লোকালে চেপে শেষ স্টেশন বজবজ। সেখান থেকে অছিপুরগামী অটোয় চেপে বড়োবটতলায় নেমে বাঁহাতি রাস্তা ধরে এগোতেই চিনেম্যানতলা। ধর্মতলা বা তারাতলার মোড় থেকে ৭৭ নম্বর বাসে চেপে অছিপুর বড়োবটতলায়। সরাসরি গাড়ি করে তারাতলা মোড় থেকে বজবজ ট্রাঙ্ক রোড ধরে সম্প্রীতি উড়ালপুল হয়ে পৌঁছে যেতে পারেন অছিপুরে।

Related Articles