আইপিএল-এর দাপটে গুরুত্ব হারাচ্ছে রঞ্জি ট্রফি!
Ranji Trophy losing importance due to IPL dominance!

অমিত লাহা: ২২ শে মার্চ থেকে শুরু হয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় ক্রিকেট প্রতিযোগিতা ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ (আইপিএল)। এ বছর অনুষ্ঠিত হচ্ছে এই প্রতিযোগিতার ১৮তম সংস্করণ। যে স্টেডিয়াম গুলিতে আইপিএলের ম্যাচ অনুষ্ঠিত হচ্ছে, সেখানে বিপুল পরিমাণ দর্শকের উপস্থিতি প্রমাণ করছে, গত ১৭ বছরে এই প্রতিযোগিতার জনপ্রিয়তায় বিন্দুমাত্র ভাটা পড়েনি।
আইপিএলের সুবাদে একাধিক তরুণ ভারতীয় ক্রিকেটার নিজের জাত চিনিয়েছেন, যারা পরবর্তীকালে জাতীয় দলের হয়ে সাফল্যের সঙ্গে খেলেছেন ও বর্তমানে খেলছেন। প্রতিবছরই আইপিএল থেকে কোনও না কোনও তরুণ প্রতিভা উঠে আসছে, যা ভারতীয় ক্রিকেটার পক্ষে অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক। বিগত কয়েক বছরে রিঙ্কু সিং, যশস্বী জয়সওয়াল, অর্শদীপ সিং, তিলক বর্মার মতো ক্রিকেটাররা যেমন ভারতীয় ক্রিকেটের মূলস্রোতে উঠে এসেছেন, তেমনই এবছর এখনও পর্যন্ত ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার হিসেবে দুর্ধর্ষ ব্যাটিং করে ক্রিকেট পণ্ডিতদের সমীহ আদায় করে নিয়েছেন আশুতোষ শর্মা, প্রিয়াংশ আর্য।
তবে কি আইপিএল-ই হয়ে উঠছে ভারতীয় ক্রিকেট দলের সাপ্লাই লাইন? অন্যদিকে গুরুত্ব হারাচ্ছে রঞ্জি ট্রফি, দলীপ ট্রফির মতো প্রাচীন ঘরোয়া ক্রিকেট প্রতিযোগিতাগুলি? বর্তমানে কিছু ক্রিকেটারের মানসিকতাতেও পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তারা রঞ্জি ট্রফি, দলীপ ট্রফির ম্যাচ না খেলে সরাসরি আইপিএল খেলার প্রতিই বেশি মনোযোগ দিচ্ছেন। যেমন, গত মরসুমে ঈশান কিসান ব্যক্তিগত কারণের অজুহাত দিয়ে রঞ্জি ট্রফির ম্যাচ খেলা এড়িয়ে গিয়েছিলেন। এই ঘটনায় বিসিসিআই ঈশানের বিরুদ্ধে শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগ আনে।
ভারতের তরুণ ক্রিকেটারদের রঞ্জি ট্রফি খেলার প্রতি এই অনীহার পেছনে পয়লা নম্বর কারণ যদি অর্থ হয়, তা হলে দ্বিতীয় কারণটি অবশ্যই গ্ল্যামার। রঞ্জি ট্রফি খেলে একজন ক্রিকেটার খুব বেশি হলে লক্ষাধিক টাকা উপার্জন করতে পারবে। কিন্তু একবার আইপিএলের নিলামে নিজের নাম অন্তর্ভুক্ত করাতে পারলে সেই ক্রিকেটারের দাম টাকার মূল্যে কোন উচ্চতায় পৌঁছবে, তা আমজনতার ধারণার বাইরে। এছাড়া আইপিএলে মাঠ ভর্তি দর্শকের সামনে খেলা, ফিল্মি তারকাদের দলে সুযোগ করে নিয়ে নিজের ব্র্যান্ড ভ্যালু বাড়িয়ে নিতে পারলে বিজ্ঞাপনের জগতেও নিজেকে প্রতিষ্ঠা করা অনেক সহজ হবে।
আজ পর্যন্ত রঞ্জি ট্রফিতে সর্বাধিক রান সংগ্রহকারী ব্যাটসম্যান অথবা সর্বাধিক উইকেট সংগ্রহকারী কোনও বোলারকে দিয়ে কোনও কোম্পানি তাদের ব্র্যান্ডের বিজ্ঞাপন করিয়েছে, এরকম ঘটনা সচরাচর চোখে পড়ে না। কিন্তু আইপিএলে মরসুমের একটা ম্যাচে কোনও ব্যাটসম্যান ৬ বলে ৬ টা ছক্কা মেরে ফেলতে পারেন, বা কোনও বোলার যদি ওভারের ৬ টা বলের মধ্যে ৩ তে বল ঘণ্টায় ১৫০ করে ফেলতে পারেন, তা হলেই তিনি তারকা হয়ে যায়। তখন সেই ক্রিকেটারের কাছে জাতীয় দলের দরজা থেকে বিজ্ঞাপন জগতের দরজা সবই খুলে যায়।
বছরে মাত্র দু’মাস ক্রিকেট খেলে যদি এত কিছু পাওয়া যায়, তা হলে শুধু শুধু একজন ক্রিকেটার ফাঁকা মাঠে কম পারিশ্রমিকে রঞ্জি ট্রফি, দলীপ ট্রফির ম্যাচ কেনই বা খেলতে যাবেন? বিসিসিআই অবশ্য বর্তমানে নিয়ম করে বোর্ডের প্রত্যেক চুক্তিবদ্ধ ক্রিকেটারের রঞ্জি ট্রফি, দলীপ ট্রফির মতো ঘরোয়া প্রতিযোগিতায় খেলা বাধ্যতামূলক করেছে। ইংল্যান্ডের ক্রিকেটাররা সারা বছর বিশ্বের বিভিন্ন টি-২০ ক্রিকেট লিগে খেললেও কাউন্টি ক্রিকেটের গুরুত্ব কিন্তু তাদের কাছে কমেনি। তেমনই অস্ট্রেলিয়াতে বিগব্যাশ টি-২০ লিগ চালু হলেও অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটাররা নিয়মিত শেফিল্ড শিল্ডের ম্যাচে অংশগ্রহণ করে থাকেন।
এদিকে আইপিএল শুরু হওয়ার পর কিন্তু ভারতের দ্বিতীয় বার টি-২০ বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হতে ১৭ বছর সময় লাগলো। এর আগে ভারত শেষবার টি-২০ বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ২০০৭ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রতিযোগিতার প্রথম সংস্করণে। সেই বিশ্বজয়ী দলের প্রত্যেকটি ক্রিকেটার ভারতীয় দলে সুযোগ পেয়েছিলেন সে মরসুমের রঞ্জি ট্রফি, দলীপ ট্রফির পারফরম্যান্সের ভিত্তিতেই। বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ চালু হওয়ার পর ভারত দু’বার ফাইনাল খেলেছে এবং দু’বারই পরাজিত হয়েছে। প্রথমবার নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে ও দ্বিতীয়বার অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে। দু’বারই পরাজয়ের প্রধান কারণ ভয়াবহ ব্যাটিং বিপর্যয়।
অত্যাধিক টি-২০ ম্যাচ খেলার ফলে বর্তমানে বিশ্বের সব ব্যাটসম্যানদেরই ধৈর্য ক্রমশ কমতে শুরু করেছে। টেস্ট ম্যাচে সেই ব্যাটসম্যানদেরই সফল হওয়ার সুযোগ বেশি থাকে যাঁরা দীর্ঘক্ষণ ধৈর্য্য ধরে উইকেটে টিকে থেকে ব্যাটিং করার মানসিকতা দেখাতে পারেন। অথচ টেস্ট ম্যাচে অধিকাংশ ব্যাটসম্যানই এখন ইনিংসের শুরু থেকেই টি-২০ ম্যাচের মেজাজে বেপরোয়া ভাবে চালিয়ে খেলতে আরম্ভ করছেন। এর ফলে দ্রুত উইকেট পতনের প্রবণতা বেড়ে যাচ্ছে। টেস্ট ক্রিকেটে শুধুমাত্র শট খেলা নয়, বল ছাড়াটাও যে একটা শিল্প, তা এখনকার দিনে ব্যাটসম্যানরা ভুলতে বসেছেন। শুধুমাত্র আইপিএলের মতো জাঁকজমক পূর্ণ টি-২০ লিগ আয়োজন করলেই দেশের ক্রিকেটকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।
এইসব লিগ ক্রিকেটে খেলে কিছু তরুণ ক্রিকেটার উঠে আসবে এ কথা ঠিক, কিন্তু সেই ক্রিকেটারদের রঞ্জি ট্রফি, দলীপ ট্রফির পারফরম্যান্স বিচার করে তবেই জাতীয় দলে সুযোগ দেওয়া উচিত। তা হলে তাদের রঞ্জি ট্রফি, দলীপ ট্রফির গুরুত্ব যেমন বাড়বে, তেমনই তারা নিজেকে একজন ক্রিকেটার হিসেবে আরও দক্ষ করে গড়ে তুলতে পারবেন। কারণ, ক্রিকেটীয় দক্ষতায় শান দিতে চাইলে ও নিজেকে আরও দক্ষ ব্যাটসম্যান বা বোলার হিসেবে গড়ে তুলতে চাইলে রঞ্জি ট্রফি, দলীপ ট্রফি, শেফিল্ড শিল্ড, কাউন্টি ক্রিকেটের আজও কোনও বিকল্প নেই।