রাজ্যে থেকে রেকর্ড পরিমাণ মাছ রফতানি, একান্ত সাক্ষাৎকারে আর কী বললেন মৎস্যমন্ত্রী
Record amount of fish exported from the state, what else did the Fisheries Minister say in an exclusive interview?

Truth Of Bengal: রাজ্যে রেকর্ড পরিমাণ মাছ উৎপাদিত হওয়ায় মাছ রফতানিতে আশাতীত সাফল্য পেয়েছে মৎস্য দফতর। দেশ-বিদেশে মোট ১৪,২১৩৭ মেট্রিক টন মাছ রফতানি করে রেকর্ড সৃষ্টি করেছে রাজ্যে সরকার। রাজ্যেকে আর মাছের জন্য অন্ধ্রপ্রদেশের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হবে না। আগামীদিনে মাছ উৎপাদনে অন্ধ্রপ্রদেশকে ছড়িয়ে যাবে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। পরিস্থিতি এমন হবে যে এবার অন্ধ্রপ্রদেশকেই মাছের জন্য পশ্চিমবঙ্গের উপর নির্ভরশীল হয়ে থাকতে হবে। সমস্ত কিছু ঠিক থাকলে আগামী দিনে রাজ্যে সরকার অন্ধ্রপ্রদেশকে মাছ রফতানি করতে সক্ষম হবে। একান্ত সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন রাজ্যের মৎস্যমন্ত্রী বিপ্লব রায় চৌধুরি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সুবীর মুখোপাধ্যায়।
প্রশ্ন– রাজ্যে থেকে মাছ রফতানি বাড়ছে। এই রফতানির পরিমাণ কত?
উত্তর– পশ্চিমবঙ্গ দেশের মধ্যে বৃহত্তম মাছের চারা উৎপাদনকারী রাজ্যে এবং দ্বিতীয় মাছ উৎপাদনকারী রাজ্যে হিসাবে স্থান লাভ করেছে।
চলতি আর্থিক বছরে ২০২৪-২৫ সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত ৫৯০৬৩ মেট্রিক টন মাছ উৎপাদন হয়েছে। আর্থিক বছরে ২০২৩-২৪ এই রফতানির পরিমাণ ছিল ১৪,২১৩৭ মেট্রিক টন। চলতি আর্থিক বছরের শেষে বিগত বছরের তুলনায় আরও বেশি পরিমাণ মাছ উৎপাদন এবং রফতানি করতে পারব বলে আশা করছি।
প্রশ্ন– রাজ্যে থেকে কী ধরনের মাছ বিদেশে রফতানি করা হয়?
উত্তর– আমাদের রাজ্যে থেকে মূলত সেল ফিশ মাছ বিদেশে রফতানি করা হয়। মূলত বাগদা চিংড়ি, ভেনামি চিংড়ি, নরম খোলোশ যুক্ত কাঁকড়া। এ ছাড়াও বিভিন্ন রকমের বাহারি মাছ বিদেশে রফতানি করা হয়ে থাকে আমাদের রাজ্যে থেকে।
প্রশ্ন– রাজ্যে ইলিশ মাছ উৎপাদনে কতটা সফল। আগামী দিনে ইলিশ উৎপাদন বৃদ্ধির কী ধরনের পরিকল্পনা রয়েছে?
উত্তর– ইলিশ মাছ উৎপাদন এবং ধরার ক্ষেত্রে রাজ্যে মৎস্য দফতর সরাসরিভাবে যুক্ত। ইলিশ মূলত পরিযায়ী। বংশ বিস্তারের জন্য ইলিশ মাছ নদীর মিঠা জলে চলে আসে। বিভিন্ন কেন্দ্রীয় গবেষণা কেন্দ্রে ইলিশের কৃত্রিম প্রজনন এবং বদ্ধ জলাশয়ে ইলিশ মাছ চাষ করা হচ্ছে। রাজ্যে মৎস্য দফতর মূলত এই মাছ উৎপাদনের কাজে যুক্ত। ইলিশ রাজ্যের নদী পথের সাহায্যে আমদের রাজ্যে চলে আসে। সংশ্লিষ্ট জেলাগুলিতে দফতর সরা বছর ধরে বিভিন্ন সচেতনমূলক কাজের সঙ্গে যুক্ত। নদীর নাব্যতা কমে যাওয়া, দূষণ সহ বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্ত্বেও রাজ্যে ইলিশ উৎপাদনে একাধিক প্রকল্প নেওয়া হয়েছে।
প্রশ্ন– রাজ্যে মাছের উৎপাদন বাড়ছে। চলতি আর্থিক বছরে এর পরিমাণ কত?
উত্তর– ২০২৪-২৫ আর্থিক বছরে ডিসেম্বর মাস অবধি রাজ্যে ১৭.০৮ লক্ষ মেট্রিক টন মাছের উৎপাদন হয়েছে। ২৩-২৪ আর্থিক বছরে ২২০৮ লক্ষ মেট্রিক টন মাছের উৎপাদন হয়েছিল। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার মাছের সব থেকে বেশি উৎপাদন হয়ে থাকে। ২০২৩-২৪ আর্থিক বছরে এই জেলায় মোট মাছের উৎপাদন ৩০৮৫৮৫ লক্ষ মেট্রিক টন।
প্রশ্ন– পুকুর বুজিয়ে বহুতল নির্মাণের অভিযোগ করছে বিরোধীরা। মৎস্য দফতর এই বেআইনি কাজের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নিচ্ছে?
উত্তর– সাম্প্রতিককালে পুকুর বুজিয়ে বহুতল নির্মাণের কোনও অভিযোগের প্রমাণ নেই। তবে পশ্চিমবঙ্গ আন্তদেশীয় মৎস্য চাষে আইন অনুযায়ী পঞ্চায়েতে অঞ্চলের ক্ষেত্রে জেলাশাসক, পুর অঞ্চলে স্থানীয় আধিকারিক, কাউন্সিলর, আধিকারিকরা দায়িত্বে আছেন। এছাড়াও জেলার সহ মৎস্য অধিকর্তা, ব্লক মৎস্য চাষ সম্প্রসারণের অধিকারিকরা সমস্ত কিছু নজরে রাখেন এবং সাধারণ মানুষকে এই ব্যাপারে সচেতন করে থাকেন। জেলাশাসকের নির্দেশ অনুযায়ী তদন্ত এবং আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার অধিকার দেওয়া আছে।
প্রশ্ন– মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে মৎস্য দফতর কী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে?
উত্তর– মাল্টিপল স্টকিং, মাল্টিপল হার্ভেস্টিং, পদ্ধতিতে মাছ চাষ করা হয়। ময়না মডেল পদ্ধতিতে মাছচাষ করার ব্যবস্থা আছে। এই পদ্ধতিতে বড় জলাশয়ে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বড় মাছের চাষ হয়ে থাকে। পুকুরে বায়োফ্লিংক পদ্ধতিতে মাছ চাষ করা হয়। পুন আবর্তনীয় পদ্ধতি আছে। পার্বত্য অঞ্চলে চৌবাচ্চায় ট্রাউট মাছের চাষ করা হয়ে থাকে।
প্রশ্ন– মৎস্য গবেষণাগার আধুনিকরণের জন্য দফতর কতটা সফল?
উত্তর– এই মুহূর্তে রাজ্যে মৎস্য দফতরের অধীনে মৎস্য চাষ সংক্রান্ত তিনটি গবেষণা কেন্দ্র রয়েছে। কল্যাণীতে মিঠা জলে মাছ চাষ, পৈলানে মাছের রোগ নির্ণায়ক কেন্দ্র, জুনপুটে মিঠা এবং নোনা জলে মাছ চাষ করা হয়। এছাড়াও প্রতিটি ব্লকে মাছ চাষ পুকুরের জল মাটি পরীক্ষার জন্য ছোট পরীক্ষাগারের ব্যবস্থা রয়েছে। জুনপুটে নোনা জলে চিংড়ি রোগ নির্ণায়ক সংক্রান্ত একটি গবেষণাগার তৈরি করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
চক গড়িয়ায় মৎস ও প্রাণী সম্পদ বিশ্ববিদ্যালয় মৎস্যবিজ্ঞানের উন্নতির কল্পে সমস্ত রকমের সহযোগিতা করছে। চতুর্থবর্ষের ছাত্র-ছাত্রীরা মৎস্যজীবীদের সাহায্যে প্রতি বছর কল্যাণী এবং জুনপুটে মৎস্যচাষিদের প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছে। মৎস্য দফতরের আর্থিক সহায়তায় এই বিশ্ব বিদ্যালয় মোট ৬ কোটি টাকা ব্যয়ে উন্নতমানের মৎস্য গবেষণা তৈরি করা হয়েছে।
প্রশ্ন– অ্যারিজোন বিশ্ববিদ্যালয় মৎস্য দফতরকে কী ধরনের সহযোগিতা করছে?
উত্তর– নোনাজলে চিংড়ি, কাঁকড়া চাষযোগ্য প্রজাতির প্রজননের ক্ষেত্রে প্রাথমিক প্রতিকূল হল এদের সুনিদিষ্ট প্রাকৃতিক খাদ্য সরবরাহ করা হয়। অ্যারিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগিতায় এই প্রতিবন্ধকতা কাটাতে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এছাড়াও চিংড়ির বিভিন্ন রোগ নির্ণায়নের জন্য উন্নত প্রযুক্তির ব্যবস্থা নিতে পরামর্শ নেওয়া হচ্ছে।
প্রশ্ন– অন্ধ্রপ্রদেশে কি মাছ উৎপাদনে টেক্কা দেওয়া সম্ভব?
উত্তর– মাছ উৎপাদন দেশের মধ্যে প্রথম। অন্ধ্রপ্রদেশকে টেক্কা দেওয়া সম্ভব। এবং এই ব্যাপারে রাজ্যে মৎস্য দফতর শুধু আশাবাদীই নয়, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের যথাযতভাবে সচেষ্ট।
প্রশ্ন– জুনপুটের ল্যাবরেটরিতে কী ধরনের কাজ হচ্ছে?
উত্তর– জুনপুটে মাছ উৎপাদনের বৃদ্ধির পাশাপাশি মাছ চাষিদের দেখানোর জন্য বর্তমানে বিভিন্ন কাজ চলছে। রাজ্যের মাছ উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে জুনপুটে গিফট তেলাপিয়া চাষের জন্য বিভিন্ন প্রকল্পের কাজ চলছে।
প্রশ্ন– মৎস্য চাষিদের প্রশিক্ষণের কী ব্যবস্থা সরকারের আছে। থাকলে কতজন সহায়তা পেয়েছেন?
উত্তর– মাছ চাষিদের উপযুক্ত আধুনিক মাছ চাষের প্রযুক্তির প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। এই বছরে ৪৮,০০০ মৎস্যচাষিদের উন্নত প্রযুক্তি দেওয়া হচ্ছে।
প্রশ্ন– কত জন মৎস্যজীবী ক্রেডিট কার্ড পেয়েছেন। ব্যাঙ্ক ঋণের পরিমাণ কত?
উত্তর– ২২,০৭৮ জন মৎস্যজীবীকে ক্রেডিট কার্ড দেওয়া হয়েছে। ব্যাঙ্ক থেকে মৎস্যজীবীরা মোট ১৫১.৫৩ কোটি টাকার ঋণ পেয়েছেন। ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক মৎস্যজীবীদের ২.০ লাখ টাকা পর্যন্ত ৫ শতাংশ সুদ ছাড় সহ ক্ষুদ্র মেয়াদে ঋণের সুবিধা দেওয়া হয়েছে। সারা রাজ্যে এখন পর্যন্ত মোট ৮৪,৭৫৬৬জন মৎস্যজীবীকে নিবন্ধিকরণ করা হয়েছে। মৎস্যজীবী বন্ধু প্রকল্পে ২৮২জন মৎস্যজীবী উপকৃত হয়েছেন। এই মৎস্য কাজের সঙ্গে যুক্ত সকলকে এক ছাদের তলায় নিয়ে আনা হয়েছে।
প্রশ্ন– মৎস্য দফতরের বরাদ্দের পরিমাণ কত করা হয়েছে?
উত্তর– চলতি আর্থিক বছরে মৎস্যজীবীদের স্বার্থে দফতরের বরাদ্দ বৃদ্ধি করে মোট ৪৮৮কোটি টাকা করা হয়েছে।
প্রশ্ন—‘জল ধরো, জল ভরো’ প্রকল্প কতটা বাস্তবায়িত হয়েছে?
উত্তর– স্বাদু জলের মৎস্য চাষ বৃদ্ধিতে বিজ্ঞানসম্মত ভাবে মৎস্য চাষের জন্য ৪,৩৭৩টি পুকুরকে এর আওতায় আনা হয়েছে। মৎস্যজীবীদের বিভিন্ন পরিকাঠামো উন্নয়নে বঙ্গ মৎস্যযোজনা নামে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। মোট ৩২.৬২ কোটি টাকা ব্যয়ে ২,৬২১টি সুবিধাদায়ী প্রকল্প সম্পূর্ণ হয়েছে। সুবিধাদায়ী নয় এমন কাজের প্রকল্পের জন্য ৩০.৪৬ কোটি টাকা খরচ করেছে দফতর।
প্রশ্ন– কংসাবতী পাইলট প্রকল্প কতটা রূপায়ণ করা সম্ভব হয়েছে?
উত্তর– কংসাবতী আবদ্ধ জলাধারে মৎস চাষ প্রকল্প নামে পাইলট প্রজেক্ট প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে এই প্রকল্পে আইসিএআর- সিআইএফআরআই- এর সাহায্য নেওয়া হয়েছে। যার ফলে এখন পর্যন্ত প্রায় ৫০মেট্রিক টন মাছ উৎপাদন সম্ভব হয়েছে।