সম্পাদকীয়

ডিজিটাল দুনিয়ায় দ্রুত পাল্টাচ্ছে বই পড়ার ধরন

The way we read books is changing rapidly in the digital world

মহম্মদ মফিজুল ইসলাম: আজ তেইশে এপ্রিল। বিশ্ব বই দিবস। প্রতিবছর এই দিনটি বেশ সাড়ম্বরে উদযাপিত হয় গোটা বিশ্বে। সাহিত্য জগতের দুই অমর স্রষ্ঠা বিশ্ববরেণ্য উইলিয়াম শেক্সপিয়র ও মিগেল দ্য সারভান্তিস এই দিনটিতে প্রয়াত হয়েছিলেন। বইপ্রেমী মানুষের কাছে এই দিনটি একটি বিশেষ দিন। প্রতীকী তাৎপর্য তো আছেই। মানুষকে বই পড়ায় উদ্বুদ্ধ করা, কৃতী লেখকদের সম্মান ও শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করা এবং অবশ্যই তরুণ প্রজন্মকে গ্রন্থ জগতের সান্নিধ্যে আনার লক্ষ্যে ও সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে ইউনেস্কো এই দিনটি ‘বিশ্ব বই দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করে।

বই, ভাল বই মানুষের ভাল সঙ্গী। নিঃসঙ্গতার মাঝে সবচেয়ে বড় অবলম্বন। বই কাজ করে সংযোজক বা সেতুবন্ধন হিসেবে। শোনা যায়, হেলেন কেলার ও জন মিলটন শেষ জীবনেও বইকে স্পর্শ করেই আত্মসুখ অনুভব করেছেন। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য– স্পেনের কাতালোনিয়া শহরে নতুন বই কেনার সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যেক ক্রেতার হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয় একটি করে টকটকে লাল তাজা গোলাপ। গোলাপের সুবাসে পাঠক উৎফুল্ল হয়।

নিজেকে ভাগ্যবান মনে করেন। এতে ক্রেতার প্রতি যেমন সম্মান প্রদর্শিত হয় তেমনই বইয়ের লেখকের প্রতিও জানানো হয় শ্রদ্ধার্ঘ্য। বই ও গোলাপের এই মেলবন্ধন অভিনব। অতুলনীয়। পরিবর্তনশীল সমাজ ব্যবস্থায় দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে সব। অথচ স্পেনীয় এই রীতি এখনও বহমান। এ এক দারুন অনুভূতি। উপহার হিসেবে বই অন্যান্য মূল্যবান উপহারের চেয়েও ‘দামী’। উপহার হিসেবে বই তো ভাল লাগেই। তার সঙ্গে তাজা গোলাপ পেলে একেবারে সোনায় সোহাগা। কল্লোলিনী কলকাতায় এমনটি কবে হবে? প্রকাশকরা কী ভাবছেন?

শুধু বই দিবস হিসেবে নয়, এই দিনটি পালিত হয় ‘দ্য প্রোটেকশন অফ ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি থ্রু কপিরাইট’ অর্থাৎ ‘স্বত্বাধিকার দিবস’ হিসেবেও। বলা হয়, সাহিত্য ও শিল্পের ক্ষেত্রে ‘কপিরাইট’ রক্ষাকবচ। লেখক ও শিল্পীর স্বার্থরক্ষায় যা অত্যন্ত জরুরি। লেখক ও শিল্পীর অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসলকে যে কোনও ধরনের ‘পাইরেসি’র হাত থেকে বাঁচাতে কপিরাইট ছাড়া আর কোনও বিকল্প পথ নেই। এই দিনটি শুধু ঘটা করে পালন করলেই আমাদের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। আমরা যারা লেখক, পাঠক তাঁদের কাছে এই দিনটি অঙ্গীকার গ্রহণের দিন। শপথ নেওয়ার দিন। কী অঙ্গীকার? কী শপথ? বই কিনব। বই পড়ব। উপহার দেব বই।

বই-ই জয় করে পাঠকের মন। মনের জানালা খুলে দেয় বই। যাঁরা বই পড়েন তাঁরা জানেন, তাঁরা মানেন বইয়ের কোনও বিকল্প নেই। বই ছাড়া হৃদয়, মন ও মেধার পরিপূর্ণ বিকাশ হয় না। বইয়ের ভাষাই গোটা বিশ্বের ভাষা। কোনও ভৌগোলিক সীমারেখা দিয়ে তাকে বেঁধে রাখা যায় না। লেখকের মৃত্যুর শত বছর পরেও লেখক বেঁচে থাকেন বইয়ের দৌলতে। পাঠকের হৃদয়ে। যে ভাষায় বই লেখা হোক না কেন, পাঠক তাঁর নিজের পছন্দের বই নিজের ভাষায় বেছে নেবেই। দেশি-বিদেশি, নৈতিক-অনৈতিক, রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক, দুর্বোধ্য-সুবোধ্য এসব বিশেষণ বইয়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। পাঠক তাঁর পছন্দকেই প্রাধান্য দেবে। কারণ সে জানে, ‘দেয়ার ইজ নো সাচ থিং আ মরাল অর ইম্ মরাল বুক, বুকস আর ওয়েল রিটেন অর ব্যাডলি রিটেন।’

এখনও অনেক মানুষ আছেন, যাঁরা রোজই মুঠো মুঠো টাকা ওড়ান। বাজে খরচ করেন। যাঁরা অন্য ধরনের নেশায় আসক্ত তাঁরা বই সম্পর্কে নাক সিঁটকোবেন। উদাসীনতা দেখাবেন। অবজ্ঞা দেখাবেন। ব্যঙ্গ, বিদ্রুপ করবেন। তাচ্ছিল্যের হাসি হাসবেন। এটাই স্বাভাবিক। তাতে আমাদের কী?  বিশ্ব বই দিবসে আমরা তাঁদের জন্য বড় জোর একটু দুঃখ প্রকাশ করতে পারি। তা ছাড়া আর কী-ই বা করতে পারি?

তবে বর্তমানে বইয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে বইপাগলদের মনে একটা তীব্র আশঙ্কা রয়েছে। ছাপা বইকে হটিয়ে দ্রুত জায়গা করে নিচ্ছে ই-বুক। ইন্টারনেটের যুগে রোজ রোজই বাড়ছে ই-বুকের বিক্রি। স্বাভাবিকভাবেই ধাক্কা খাচ্ছে ছাপা বইয়ের বাজার। তবে একটা অদ্ভুত বৈপরীত্য দেখা যাচ্ছে বই বিশ্বে। একদিকে, বিশ্বের কিশোর-কিশোরীরা এখন আইপ্যাড, কিন্ডল, ট্যাবলেট ও কোবো’র মতোই ই-রিডারে মগ্ন। অন্যদিকে, বহু পাঠক ফিরে যাচ্ছেন সেই ছাপার অক্ষরেই।

যা-ই হোক পাঠকের বই পড়ার ভঙ্গিটাই এখন দ্রুত বদলে যাচ্ছে। বাঁধানো বইয়ের পাতা পরপর উল্টে পড়ার অভ্যাস এখন যেন সাবেক। এখন স্ক্রিনের উপর চোখ রেখে মাউস ক্লিক করা বা স্ক্রল করে পড়া মজায় মেতেছে অনেকেই। সে যা-ই হোক, পাঠক বই পড়ছে। সে ছাপাখানার বাঁধানো বই হোক আর ই-বুক হোক। এটা ভাল লক্ষণ।

বইয়ের ভবিষ্যৎ আর ভবিষ্যতের বই নিয়ে ইতিমধ্যে একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন হয়েছে। ছাপানো টেক্সট থেকে ডিজিটাল টেক্সট, ডিজিটাল টেক্সট থেকে হাইপার টেক্সটে পৌঁছে যাচ্ছে এখনকার পাঠক। সেখানে সারি সারি শেলফের গোলক ধাঁধা নেই। নেই বইয়ের বর্গীকরণ। ই-বুকের দুনিয়ায় ছাপানো বইয়ের রূপ-রস-গন্ধ-স্পর্শ পুরোপুরি ভ্যানিশ।

ই-মেইল ও এসএমএস-এর যুগে পাঠকের বই পড়ার ধরনটাই বদলে গিয়েছে। একালের অজস্র পাঠক যে অনেকখানি ডিজিটাল হয়ে পড়েছে এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। পড়ার অভ্যাসটা এখন অনেকটাই কম্পিউটার নির্ভর। তবে ছাপা বই হোক আর ই-বুক হোক– মোদ্দা কথা হল, পাঠক পড়ছেন। নতুন বইয়ের পাশাপাশি বহু প্রাচীন ও দুষ্প্রাপ্য অজস্র বই এখন ইন্টারনেট থেকে ঝপাঝপ ডাউনলোড করে পটাপট পড়া যাচ্ছে। তা হলে ভবিষ্যতে ছাপা বইয়ের ভবিষ্যৎ কী অনিশ্চিত? প্রশ্ন জাগছে।

আশঙ্কা যা-ই হোক প্রযুক্তিগত সুবিধা এখনও সব পাঠকের ঘরে পৌঁছয়নি। তাই আপাতত ছাপা বইয়ের জায়গাটা অটুট থাকবে বলেই মনে হয়। তবে একথা অনস্বীকার্য, স্ক্রিনের কার্যকারিতা পাতার চেয়ে অনেকটাই বেশি। স্ক্রিন এমন অনেক কিছু পারে যা বইয়ের পাতা পারে না। সে যা-ই হোক বই হোক আর ই-বুক হোক দ্বৈরথে গিয়ে লাভ নেই। সবই পাঠকের জন্য। তাই পাঠক যেটা পছন্দ করে সেটা নিয়ে মেতে থাক। পড়ার অভ্যাসটা চালু থাক। কেন না প্রবাদে আছে ‘আ গুড বুক ইজ দ্য বেস্ট অফ ফ্রেন্ডস, দ্য সেম টুডে ফর এভার।’

Related Articles