কবিমনে বসন্ত আনে গভীর রোম্যান্টিক চেতনা, বসন্তের বর্ষা বর্ষার বসন্ত
Spring brings a deep romantic feeling to the poet's mind, the spring of the rainy season.

Truth Of Bengal: মধুবন চক্রবর্তী: বর্ষা আসতে এখনও দেরি। বসন্ত পার করে এখন গরম। বসন্ত আসলে তো রোমান্টিকতার প্রতিমূর্তি। সব ঋতুর গভীরে বেশ ছায়া ফেলে রাখে। সব থেকে বেশি বর্ষায়। ছয় ঋতুর মধ্যে বর্ষা এবং বসন্ত নিয়ে আমাদের আবেগ-উচ্ছ্বাসের শেষ নেই।
রবীন্দ্রনাথের কবিতা, গানেও সেই ঋতুরাজ বসন্ত বারবার ঘুরে ফিরে এসেছে। অর্থাৎ, কবি-মনের পক্ষপাতিত্ব এই বসন্তকে নিয়ে মনে হলেও বসন্তকে তিনি কখনও উদাসী গৃহত্যাগী হিসেবে দেখেছেন, কখনও কল্পনা করেছেন, রাজার মূর্তি, আনন্দের মূর্তি হিসেবে। যার গায়ে লেগে থাকে কত আলো, কত রঙ, কত প্রাণ। সে যেন স্বর্গের নর্তকী ঊর্বশী।
ক্ষণস্থায়ী এই ঋতু কবিকে আকর্ষণ করতো ঠিকই, তবু বর্ষা তাঁর খুব কাছের। কল্পনায়, স্বপ্নে, বিচ্ছেদে, প্রেমে, বিরহে সব অনুভূতিতেই যেন বসন্ত হয়েই থেকে গেছে। সব ঋতুর মধ্যে বর্ষা এবং বসন্তই তাঁকে বেশি প্রভাবিত করেছে। প্রাধান্য পেয়েছে দুই ঋতুর বৈচিত্র্যময়তা, অপার সৌন্দর্য।
ছয় ঋতুর পরিক্রমায় কবিমনকে আন্দোলিত করেছে বসন্ত। তবে এ বসন্ত শুধুমাত্র ক্ষণস্থায়ী বসন্ত নয়, যেন চিরায়ত বসন্ত। যে বসন্ত, বর্ষাতেও জোনাকির আলোর মতো নৃত্য গীত করে। যে বসন্ত জাগ্রত দ্বারে বর্ষার সংগীতেও। সেইসব সংগীত বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বর্ষার সঙ্গেও কবির আত্মীয়তা নিবিড়।
বর্ষার বিভিন্ন রঙ কবিমনে নানা ভাবে পরিক্রম করে। বর্ষার অঝোর ধারা কখনও তাকে উড়িয়ে নিয়ে যায় কালীদাসের যুগে। অতৃপ্ত বাসনা, চাওয়া পাওয়ার দ্বন্দ্ব থেকে মুক্তি পেয়ে কবি-মন অচিনপুরের যাত্রায় উধাও হয়। অচিনপুরের উদ্দেশে যেতে যেতে কবির সঙ্গে দেখা হয় ঋতুরাজ বসন্তের। বসন্ত যেন উদাসীন গৃহত্যাগী।
আর বর্ষা যেন সংসারী গৃহী। উদাসীন গৃহত্যাগী ঋতুরাজ বসন্তের ফুলরেণুকে মনের মধ্যে আগলে রেখে দেন কবি। বসন্ত কিছু বলতে চায়, কিন্তু বলতে পারে না। তাই অপ্রকাশিত বসন্ত জাগ্রত হয় কবি চেতনায়। এক আলোড়ন তৈরি করে। কবি বলে ওঠেন ‘আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে…’
এই অপ্রকাশিত বসন্ত নৈসর্গিক জগতের সন্ধান দেয়। যৌবনের দূত বসন্ত অজস্র গান নিয়ে পলাশে, শিমূলে সজ্জিত হয়ে নৃত্য করে চলে। কবিও পাগল হয়ে সেই নৃত্য দেখে চলেন। অন্যদিকে বর্ষার সঙ্গীতে যে উদাস করা সুর, সেই উদাসী সুর মিলে যায় বসন্তের গভীরে। যেন কান পেতে শোনে রোমান্টিকতার হারমোনি।
বসন্তের বাইরের রূপের আড়ালে যে সুর ধ্বনিত হয় তা হল–
‘শুকনো পাতা কে যে ছড়ায়
ওই দূরে উদাস করা কোন সুরে
ঘর ছাড়া ওই কে বৈরাগী
জানি না যে কাহারো লাগি
ক্ষণে ক্ষণে শূন্য বনে যায় ঘুরে
চিনি চিনি যেন উড়ে হয় মনে
ফিরে ফিরে যেন দেখা ওর সনে…’
কবির কাছে ধরা দেয় সেই বসন্ত।
বসন্তের আগমনে আড়মোড়া ভেঙে প্রকৃতি হয়ে ওঠে সজীব, সবুজ, প্রাণচঞ্চল যেন ভোরের পাখিটি। বসন্তের আগমনী ধ্বনিতে গাছের পাতাগুলো যেন কোরাস গাইতে থাকে। ভোরের হাওয়ার সঙ্গে মেলামেশা করতে করতে ডেকে ওঠে বসন্তের কোকিল। এ এক অদ্ভুত হারমোনি। ঋতুরাজ বসন্তের এই আগমনী বার্তায় সেতারে বেজে উঠে বসন্ত বাহার। কবি মনে বেজে ওঠে বসন্তের সুর।
রবীন্দ্রনাথের প্রিয় ঋতু বর্ষা হলেও, বসন্তের আগমন বার্তা পাওয়া যায় তাঁর অজস্র গানে কবিতায়। প্রতিটি ঋতুর সঙ্গে পরিচয় করাতে, রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে বিভিন্ন ঋতু উৎসবের আয়োজন করতেন। তারও আগে কনিষ্ঠ সন্তান সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আবদার মেনে ১৩০৩ বঙ্গাব্দে বসন্তের পঞ্চম দিনের রবীন্দ্রনাথ আয়োজন করেছিলেন ঋতুরঙ্গ উৎসবের।
বসন্তের আগমনী ধ্বনিতে কবি হৃদয় যেন আনমনা চঞ্চল। বেদনা তাড়িত। কোনোও কিছু পাওয়ার আশায় মন যেন উচাটন। অপেক্ষারত লগন বয়ে যায়। কিন্তু প্রকৃতিতে প্রত্যাশিত সেই বসন্ত তখনও যেন অধরা। তাই বিরহী মনের কাতর মিনতি
‘বসন্ত তোর শেষ করে দে রঙ্গ
ফুল ফোটাবার খ্যাপামি
তার উদ্যাম তরঙ্গ
উড়িয়ে দেবার ছড়িয়ে দেবার
মাতন তোমার থামুক এবার
নীড়ে ফিরে আসুক
তোমার পথহারা বিহঙ্গ।’
বসন্তে যন্ত্রণার মধ্যে থাকে এক আনন্দের পদধ্বনি যেন মনে হয় কোনও প্রিয় সান্নিধ্য ক্রমশ নিকটে আসতে শুরু করেছে। নিরাশার মধ্যে ডেকে ওঠে আশার সুর। তাই বসন্তের বিরহে গভীরতার থেকে বেশি কাঙ্ক্ষিত সুখ, থাকে না পাওয়ার অব্যক্ত যন্ত্রণা। বর্ষা এবং বসন্তের আবেদন যেন কোন মোহময়তায় প্রবেশ করায় তাকে। বর্ষার আকাশে অভিমানের মেঘ যখন জড়ো হয়, তখন সে একা হয়ে যায় বিশ্ব সংসারে।
মনে হয় শ্রাবণ কি বৃষ্টির ঘনঘটায় তাঁর একাকিত্ব দূর করতে পারবে? বলতে পারবে
‘হৃদয় আমার নাচেরে আজিকে ময়ূরের মত নাচে রে…’
বর্ষা আসলেই তার মন উতলা হয়ে ওঠে। আকাশে যখন তিনি দেখেন, কালো মেঘের ঘনঘটা, বাতাসে আদ্রতার ছোঁয়া, বৃষ্টি ধারায় প্রকৃতি যখন হয় সজল সবুজ, তাঁর মন তখন হয়ে ওঠে রোমান্টিক।
বর্ষামঙ্গল কবিতায় কবি বলছেন–
‘স্নিগ্ধ সজল মেঘ কজ্জল দিবসে
বিবশ প্রহর অচল অলস আবেশে
শশী তারা হীনা অন্ধতামসী যামিনী
কোথা তোরা পূবকামিনী…’
বসন্তের গর্ভেই বসবাস বর্ষার। আবার বর্ষার গর্ভজাত এই বসন্ত। বর্ষা চির রোম্যান্টিক। আর রোমান্টিসিজমের রাজাই তো বসন্ত। বাদল দিনে তাই রোমান্টিক কবির ভাবনা মেঘের সঙ্গী হয়ে উড়ে চলে দিকদিগন্তের পানে। কদম, কেতকী, হাসনুহানার গন্ধ নিয়ে বৃষ্টির সিম্ফনি কবি শুনতে থাকেন এক মায়াময় আবেশে। কবি বলে ওঠেন–
‘মোর ভাবনারে কি হাওয়ায় মাতালো ওই
দোলে মনে দোলে অকারণ হরষে…’
কবির বিরহকাতর মন কাউকে কি ব্যকুলভাবে প্রত্যাশা করে? সে প্রত্যাশা পূরণ করতে বহু যুগের ওপার থেকে আষাঢ় যেন দীর্ঘ বসন্ত পেরিয়ে আসে। এই বর্ষা ঋতুতেই কেমন নিঃসঙ্গ বেদনার ভাব ফুটে কবির মনে। সেই বর্ষণমন্দ্রিত নিঃসঙ্গ মুহূর্ত কবির ভাবনাকে উড়িয়ে নিয়ে যায় কালীদাসের যুগে। তিনি বলে ওঠেন–
‘বহু যুগের ওপার হতে আষাঢ় এলো আমার মনে
কোন সে কবির ছন্দ বাজে ঝরো ঝরো বরিষণে
যে মিলনের মালাগুলি ধুলায় মিশে হলো ধূলি
গন্ধ তারি ভেসে আসে আজি সজল সমীরণে…’
মাঝে মাঝে নিজেকেও অচেনা লাগে।
যা ছিল কবির সম্পূর্ণ আজানা, অদেখা তাকেই এতদিন অতি সংগোপনে, সন্তর্পণে নিজের মধ্যে লালন করে এসেছেন কবি। মেঘেদের সম্মেলনে আজও ভেসে আসে সেই স্মৃতি, যাকে তিনি খুঁজে বেরিয়েছিলেন আজন্মকাল, আচমকা তাকেই যেন খুঁজে পাওয়া। আবিষ্কার করেন এক অচেনা বসন্ত। একি সেই চেনা বসন্ত? বসন্তের লাবণ্য প্রভায় মুগ্ধ কবি বলে ওঠেন–
‘একি লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ প্রাণেশ হে
আনন্দ বসন্ত সমাগমে…’
মাঘ উৎসব উপলক্ষে এই গানটি রচিত হয়েছিল ১৮৯৩ সালে। এই পৃথিবীর সঙ্গে, প্রকৃতির ছয় ঋতুর সঙ্গে তাঁর গভীর আত্মীয়তা। ছিন্নপত্রগুলির অনেক স্থানে সেই আত্মীয়তার খবর পাওয়া যায়। যেমন তিনি বলছেন–
‘আমার সর্বাঙ্গে এবং সমস্ত মনের উপর বিশুদ্ধ নতনেত্র প্রকৃতির কি একটা বৃহৎ উদার বাক্যহীন স্পর্শ অনুভব করি (ছিন্নপত্রাবলী ৩১)। ওই যে মস্ত পৃথিবীটা চুপ করে পড়ে রয়েছে ওটাকে এমন ভালোবাসি, ওর ওই গাছপালা নদী ঘাট কোলাহল বিশুদ্ধতার প্রভাত সন্ধ্যা, সমস্ত দুহাতে আঁকড়ে ধরতে ইচ্ছে করে–
আমি এই পৃথিবীকে ভারী ভালবাসি..’
প্রকৃতির প্রতি তাঁর অমোঘ টান। সেই প্রকৃতির প্রাণসংগীত বসন্ত। আর অনুরাগ অভিমান যত বর্ষাকে ঘিরে। বহু কবিতা ও গানের মধ্যে দিয়ে কবি সেই অনুভূতি বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে। কখনোও শ্রাবণের আমন্ত্রণে তিনি উন্মাদ হয়েছেন। কখনও বা বসন্তের আগমনী বার্তায়। তিনি বলেছেন,
‘কোন পুরাতন প্রাণের টানে
আজ শ্রাবণের আমন্ত্রণে
কখনো বাদল ছোঁয়া লেগে…’
তাঁর রচিত বসন্ত গীতিনাট্যটি উৎসর্গ করেছিলেন কবি কাজী নজরুল ইসলামকে। ষষ্ঠ ঋতুর শ্রেষ্ঠ ঋতু বসন্তকে নিয়েই কবিগুরুর এই রচনা। রাজা ও সভাকবির কথোপকথনের বিনিসুতো দিয়ে কবিগুরু গেঁথেছিলেন বসন্তের এই গীতিমাল্যটি।
বসন্তকে তিনি খুঁজে পেতেন বর্ষার গভীরেও। বসন্ত যেখানে শুধুই রোমান্টিকতা। বর্ষার অন্তরে বিরহের গভীরতা কবির কাছে রোমান্টিকতার থেকেও বেশি কিছু। অনেক বেশি সীমাহীন। তাই তিনি বলেন–
‘ঝরঝর ঝরো ভাদরও বাদরও
বিরহকাতর শর্বরী
ফিরেছে এখন অসীম রোদন
কানন কানন মর্মরী…’
অথবা
আজি ঝর ঝর মুখর বাদর দিনে
জানিনে জানিনে কিছুতে কেন যে
মন লাগে না…’
বর্ষার সংগীত রচনা ক্ষেত্রে কবির রোমান্টিকতা প্রাধান্য পেয়েছে। বর্ষা আসলে, প্রকৃতির এক অচেনা, অজানা জগৎ উদঘাটিত হয়, অতি সংগোপনে সবার অজ্ঞাতে যাকে সে নিজেই লালন করেছে। আচমকা যখন সে তার স্বরূপ নিয়ে চলে আসে, কবি কিরকম যেন চঞ্চল হয়ে ওঠেন।
আবার এই বসন্তকে ঋতুরাজ না বলে, কখনোও রংবাজ বসন্তও বলা যায়। যত বেশি রং তত বেশি রংবাজি। বসন্ত বেশি সুন্দর বলে অহংকারীও বটে। এই বসন্তের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে আনন্দের পদধ্বনি। নিরাশার মধ্যেই জমা থাকে আকাঙ্ক্ষার সুর। কাঙ্ক্ষিত সুখ না পাওয়ার আপাতত যন্ত্রণা দগ্ধ করে হৃদয়কে। ছয় ঋতুর মধ্যে দুটি ঋতু কাব্যিক এবং সাহিত্যময় এবং সংগীতের দিক থেকেও বহুল চর্চিত রোমান্টিকও বটে।
১৩২১ সনের আষাঢ় মাসে লেখা আসার প্রবন্ধ কবি লেখেন–
‘ভারতবর্ষের প্রত্যেক ঋতুরই একটা না একটা উৎসব আছে। কিন্তু কোন ঋতু যে নিতান্ত বিনা কারণেই তাহার হৃদয় অধিকার করিয়াছে, তাহা যদি দেখিতে চাও, তবে সংগীতের মধ্যে সন্ধান করো। কেন না, সঙ্গীতেই হৃদয়ের ভিতরকার কথাটা ফাঁস হইয়া পড়ে।
বলিতে গেলে, ঋতুর রাগ রাগিণী কেবল বর্ষার আছে আর বসন্তের। সংগীত শাস্ত্রের মধ্যে সকল ঋতুরই জন্য কিছু কিছু সুরের বরাদ্দ থাকা সম্ভব। কিন্তু সেটা কেবল শাস্ত্রগত। ব্যবহারে দেখতে পাই, বসন্তের জন্য আছে বসন্ত আর বাহার আর বর্ষার জন্য মেঘ, মল্লার, দেশ এবং আরোও বিস্তর। সংগীতের পাড়ায় ভোট লইলে বর্ষারই হয় জিত…’
তার লেখায় বর্ষাকেই তিনি যে প্রাধান্য দিয়েছেন বহুবার এটাই প্রকট হয়ে উঠেছে।
পূর্ববঙ্গে থাকাকালীন ঠাকুর পরিবারের জমিদারের দেখাশোনার কাজে শিলালদায় সাজিদাপুর এবং পাতিসরে তারা অনেকদিন তাকে থাকতে হয়েছিল। সেই সময় পদ্মা নদী এবং তারও তীরবর্তী অঞ্চলে বিশেষ করে বর্ষার সময় বর্ষার সেই অপরূপ দৃশ্য তাঁকে অভিভূত করে তোলে। সেখান থেকে মধ্য বয়সে হৃদয়ে লাগে ঘোর। নতুন করে আসে রোমান্টিকতা। প্রেম বিরহ বিচ্ছেদ বেদনা সংমিশ্রিত বিবিধ অনুভতির জন্ম হয়।
বর্ষা কবির মনে প্রধানত বেদনার সুরকেই প্রতিফলিত করেছে। আর নববসন্তের মাধুর্য কবির মনে আনন্দের শিহরণ জাগিয়ে তুলেছে। একদিকে বেদনাবিধুর বর্ষাকে আবাহন করা। অন্যদিকে নববসন্তের আনন্দকেও আমন্ত্রণ জানানো। তাই কবি বসন্ত এবং বর্ষা, উভয়ের মাঝেই মধুর বেদনাবিধুর সৌন্দর্যকে আবিষ্কার করেছেন।