সিপিএম-এ দ্বন্দ্ব, অভিযোগের আঙুল কারাত পরিবারের দিকে
Conflict in CPM, finger of blame pointed at Karat family

Truth Of Bengal: সুমন ভট্টাচার্য: বাংলাদেশ নিয়ে বিতর্কে এবার সিপিএমের অন্দরে টানাপোড়েন মাথাচাড়া দিল। পশ্চিমবঙ্গে সিপিএমের ‘তাত্ত্বিক’ বলে পরিচিত, রাজ্য সম্পাদকের বিশেষ ঘনিষ্ঠ এবং ‘গণশক্তি’র নিয়মিত প্রাবন্ধিক গৌতম রায় মহম্মদ সেলিমকে চিঠি লিখে অভিযোগ করলেন, যে প্রকাশ কারাত এবং বৃন্দা কারাত এমন লোকজনদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা প্রচার করছেন, যাঁরা বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ‘জামাতের মদতপুষ্ট’ বলে অভিযুক্ত।
গৌতম রায় চিঠিতে, যে চিঠির কপি তিনি ইতিমধ্যেই অনেককে দিয়েছেন, পরিষ্কারই অভিযোগ তুলেছেন, যে বাংলাদেশের জামাতের হয়ে যাঁরা ভারতে ‘প্রোপাগাণ্ডা’ করছেন, সেইসব ভারতীয় বা আরও নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে বাঙালিদের সঙ্গে প্রকাশ কারাত এবং বৃন্দা কারাতকে দেখা গেলে পশ্চিমবঙ্গে সিপিএমের ক্ষতি হবে। পশ্চিমবঙ্গে ভোট শতাংশের নিরিখে এমনিতেই তলানিতে চলে যাওয়া সিপিএমের মধ্যে এই বিতর্ক মাথাচাড়া দেওয়ার ঘটনা অবশ্যই রাজনৈতিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ।
রাজ্যসম্মেলনের আগে সিপিএমের যখন বিভিন্ন জেলার সম্মেলন হচ্ছিল, তখনও সেখানে বাংলাদেশ নিয়ে বিতর্ক হয়েছিল, সেখানকার সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচার নিয়ে আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের নিরবতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। অনেক নিচু তলার কর্মী প্রশ্ন করেছিলেন বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের বিষয়ে মুখ খুলতে দল দ্বিধা করছে কেন? কিন্তু এবারে গৌতম রায়ের চিঠি এবং তা-ও রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিমের কাছে দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র, যে কেন প্রকাশ কারাত ও বৃন্দা কারাত, ‘জামাতের ঘনিষ্ঠ’ বলে যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে তাদের গুরুত্ব দিচ্ছেন কারাত দম্পতি? এই বিষয়টি অবশ্যই অনেক বড় রাজনৈতিক বিতর্ক তৈরি করতে পারে।
আমাদের মনে রাখতে হবে, যে বাংলাদেশ নিয়ে ইতিমধ্যেই কেন্দ্রের শাসকদল বিজেপি সুর চড়িয়ে রেখেছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের পাশে দাঁড়িয়ে বিবৃতি দিয়েছেন। ঠিক সেই সময় সিপিএমের সর্বোচ্চ নেতৃত্ব অর্থাৎ প্রকাশ কারাত-বৃন্দা কারাতের বিরুদ্ধে ‘জামাতের মদতপুষ্ট’ তোল্লা দেওয়ার অভিযোগ দলেরই এক তাত্ত্বিক নেতা তোলেন, তাহলে তার আলাদা রাজনৈতিক তাৎপর্য রয়েছে। গৌতম রায় তাঁর চিঠিতে পরিষ্কারই বলেছেন, যে দলের সর্বোচ্চ নেতানেত্রীরা যদি এমন লোকেদের সঙ্গে মেশেন বা এমন লোকেদের গুরুত্ব দেন, যাঁদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের’ জামাতের হয়ে প্রোপাগান্ডা করা’র বা ইউনুস সরকারের হয়ে ভারতে ‘প্রোপাগাণ্ডা’ করার অভিযোগ রয়েছে, তাহলে মানুষের কাছে সিপিএমের সম্পর্কে অত্যন্ত খারাপ ধারণা যাবে।
গৌতম রায়ের সিপিএমের রাজ্য সম্পাদককে লেখা এই অভিযোগপত্র ঠিক সেই সময় সামনে এল, যখন সিপিএম এমনিতেই বিভিন্ন বিষয়ে কোণঠাসা। সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির তরফে আর বিজেপিকে ‘ফ্যাসিবাদী’ দল বলে মনে হচ্ছে না এই পার্টি নোট সামনে আসার পরে কেরালায় কংগ্রেস থেকে বামেদের অন্য সহযোগী দলগুলিও ঝাঁপিয়ে পড়েছে সমালোচনা করতে। কিন্তু প্রকাশ কারাত এবং বৃন্দা কারাত, সিপিএমের শীর্ষ নেতৃত্ব দম্পতি জামাতের ‘প্রোপাগাণ্ডা’ যাঁরা করেন, তাঁদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখছেন, এই বক্তব্য অবশ্যই বামেদের কোণঠাসা করবে এবং বিজেপি, কংগ্রেস তৃণমূলকে আরও বেশি করে দেশের প্রধানতম বাম দলটির বিরুদ্ধে অভিযোগ শানানোর সুযোগ করে দেবে।
এমনিতেই বিজেপি কীভাবে মহিলাদের দেখে, তা নিয়ে বৃন্দা কারাত অতি সম্প্রতি যে বইটি লিখেছেন, সেই নিয়ে গেরুয়া শিবির তুমুল আক্রমণে গিয়েছে। তার কারণ সেই বইয়ের নামকরণ। বইয়ের নামকরণে যেভাবে ‘শব্দ’ এর ব্যবহার হয়েছে, তাতে বিজেপির হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়া হয়েছে বলে অনেক রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকই মনে করেন। কিন্তু ঠিক সেই সময় প্রকাশ কারাত বা বৃন্দা কারাতের বিরুদ্ধে এহেন গুরুতর অভিযোগ এনে দলেরই এক তাত্ত্বিক নেতা, যিনি আর এস এস সম্পর্কে বই লিখেছেন এবং নিয়মিত ‘গণশক্তি’তে প্রবন্ধ লেখেন, তিনি যদি মুখ খোলেন এবং খোদ রাজ্যসম্পাদককে চিঠি লেখেন, তাহলে দলের অন্দরে আলোড়ন হতে বাধ্য। গৌতম রায় এই আলোড়নকে অস্বীকারও করছেন না। এবং তিনি বলছেন, যে এই আলোড়ন হওয়াটা জরুরি। সেই কারণেই তিনি এই চিঠি লিখেছেন।
আমাদের মনে রাখতে হবে, যে সিপিএমে কট্টরপন্থী বনাম নরমপন্থীদের বিবাদ দীর্ঘদিন ধরে চলছিল। এবং প্রকাশ কারাত সিপিএমের ভিতরে কট্টরপন্থী হিসেবেই পরিচিত। সীতারাম ইয়েচুরি সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক থাকা অবস্থায় মারা যাওয়ার পরে দলের সর্বভারতীয় নেতৃত্বের তরফে প্রকাশ কারাতকেই সমন্বয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। যতক্ষণ না সিপিএম সর্বভারতীয় সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন সাধারণ সম্পাদক বেছে নিচ্ছে, ততদিন প্রকাশ কারাতই দায়িত্বে।
বিভিন্ন ইস্যুতে সিপিএমের সর্বভারতীয় নেতৃত্বের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ নেতৃত্বের বিরোধের বিষয়টি পুরোনো। আমরা জানি সেই বিরোধের অন্যতম কারণ কংগ্রেসের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়টিও । কেরলের বামনেতা হিসেবে প্রকাশ কারাত কংগ্রেসের সঙ্গে কোনওরকম সমঝোতায় যেতে কখনও রাজি হন না। সীতারাম ইয়েচুরি সাধারণ সম্পাদক থাকার সময়ে বিজেপিকে ঠেকাতে কংগ্রেসের সঙ্গে জোটের সিদ্ধান্ত হয় এবং এখন সিপিএম ‘ইন্ডিয়া’ জোটের গুরুত্বপূর্ণ শরিক। কিন্তু প্রকাশ কারাতের লাইনের বিরোধিতায় এর আগেও পশ্চিমবঙ্গ থেকে এর আগেও স্বর উঠেছিল।
এবার দলের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিমের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত তাত্ত্বিক নেতা গৌতম রায় সেই মহম্মদ সেলিমকেই চিঠি দিয়ে বললেন, ‘প্রকাশ কারাত-বৃন্দা কারাত যাঁদের সঙ্গে মেলামেশা করছেন, যাঁদের ডেকে বই উদ্বোধনে শরিক করছেন, তাঁরা আসলে বাংলাদেশের জামাতের টাকায় চলে’। আমরা যদি গৌতম রায়ের চিঠিটি মন দিয়ে পড়ি, তাহলে আমরা দেখতে পাব তিনি জামাত মদতপুষ্টদের সঙ্গে কারাত দম্পতির ঘনিষ্ঠতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
সিপিএমের সর্বভারতীয় সম্মেলেনের আগে প্রকাশ কারাত-বৃন্দা কারাতের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ ওঠা, এবং তা-ও বাংলার মাটি থেকে অবশ্যই আলাদা রাজনৈতিক তাৎপর্য বহন করে। মহম্মদ সেলিম সিপিএমের ভবিষ্যতের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক হওয়ার দৌড়ে রয়েছেন। সেই সেলিমের ঘনিষ্ঠ মহলই যদি প্রকাশ কারাত-বৃন্দা কারাতের বিরুদ্ধে অভিযোগের আঙুল তোলে, তাহলে অবশ্যই তা নিয়ে সর্বভারতীয় রাজনীতিতেও আলোড়ন উঠতে পারে। বিজেপি এই সুযোগকে হাতছাড়া করবে না, হাতছাড়া করবে না কেরলে সিপিএমের প্রতিস্পর্ধী কংগ্রেসও।
কারণ গৌতম রায় পরপর যে দুটি চিঠি লিখেছেন, সেই দুটি চিঠিতে এটাও মনে করিয়ে দিয়েছেন, যে প্রকাশ কারাত-বৃন্দা কারাত যে লাইন নিয়ে চলছেন, তাঁর দলের সর্বভারতীয় অবস্থান নয়, এমনকি জোটসঙ্গী কংগ্রেসেরও অবস্থান নয়। অর্থাৎ, ‘যাঁরা বাংলাদেশে জামাতকে সমর্থন করছেন, ইউনুস সরকারের সমর্থনে এপাশে বিভিন্ন কিছু করছেন’, তাদের যদি কারাত দম্পতির সঙ্গে দেখা যায়, তাহলে জনমানসে ভুল ভাবনা তৈরি হবে, মানুষের মনে সিপিএম সম্পর্কে আরও বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হবে।
বাংলাদেশে যখন জুলাই আন্দোলন হচ্ছিল অর্থাৎ শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে তথাকথিত বৈষম্য বিরোধী ছাত্রসমাজ আন্দোলন করছিল, তখন কলকাতায় কিছু বাম সংগঠন এবং অতি বাম সংগঠন মিছিল করেছিল। সেই মিছিলের মূল উদ্যোক্তা ছিল আরএসপি-র ছাত্র সংগঠন এবং কিছু অতি বাম ছাত্র সংগঠন। সিপিএমের ছাত্র সংগঠন এসএফআই সেই সময়ই এই ধরনের মিছিলের থেকে নিজেদের দূরত্ব তৈরি করে নিয়েছিল।
সিপিএমের ঘোষিত অবস্থান বাংলাদেশে জামাত বিরোধী। তারা ইউনুস সরকারকে বা ইউনুস প্রশাসনকে কোনও ধরনের নম্বর দিতে চায় না। এটাই রাজ্য সিপিএমের ঘোষিত অবস্থান। কিন্তু যদি রাজ্য সিপিএমের তাত্ত্বিক নেতারা দিল্লির সর্বভারতীয় নেতৃত্বের বিরুদ্ধে জামাত মদতপুষ্টদের সঙ্গে দহরম মহরমের অভিযোগ তোলেন এবং গৌতম রায় সেই চিঠি লেখেন, তাহলে কিন্তু সিপিএমের অন্দরমহলে তুফান উঠবেই।
প্রশ্ন উঠবেই বৃন্দা কারাত-প্রকাশ কারাতরা তাঁদের কংগ্রেস বিরোধিতাকে বজায় রাখতে গিয়ে কি সর্বভারতীয় ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির ব্র্যাকেট থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন? তাঁরা কি ‘ইন্ডিয়া’ জোটের অনুসৃত রীতির পথে হাঁটছেন না? গৌতম রায় কিছু সেই প্রশ্ন তুলে দিলেন। সিপিএম সূত্রে খবর মহম্মদ সেলিমের কাছে এই চিঠি পৌঁছানোর পর তিনি অত্যন্ত বিব্রত হয়েছেন।
সিপিএম সূত্রেই জানা গিয়েছে, সিপিএমের রাজ্য নেতৃত্বের তরফে একজন মহিলা নেত্রী, যিনিও তাত্ত্বিক নেত্রী হিসেবে পরিচিত, তিনি বৃন্দা কারাতকে রাজ্য পার্টির এই অসন্তোষের কথা বা অস্বস্তির কথা জানিয়ে দিয়েছেন। বৃন্দা কারাত-প্রকাশ কারাত এরপরে সংশোধনের লাইনে হাঁটেন না বাংলাদেশ প্রশ্নে সিপিএমের মধ্যে ফাটল আরও চওড়া হয়, তার দিকে সকলের নজর থাকবে।