
Truth of Bengal,সুমন ভট্টাচার্য: শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ‘আইকনিক’ গ্রন্থ, ‘যেতে পারি কিন্তু কেন যাব’, সেই অনুকরণে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কি কোনওদিন কোনও বই লিখবেন, ‘জিততে পারি কিন্তু কেন জিতি’! যদি তিনি লেখেন, তাহলে হয়তো জানা যাবে যে, সমস্ত বাধাকে অতিক্রম করে, ‘বাজারি’ মিডিয়ার রোজকার কুৎসাকে ফুঁৎকারে উড়িয়ে দিয়ে এবং ‘এলিট’দের ঘৃণাকে একেবারে ‘উপেক্ষা’ করে কীভাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গত তেরো বছর ধরে একের পর এক নির্বাচনে জিতে চলেছেন
শনিবার পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভার ৬টি আসনের উপ-নির্বাচনের ফলাফল যখন এলো, তখন বোধহয় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এরকম আর একটা বই লেখার প্রাসঙ্গিকতা আরও বেশি করে সামনে চলে এলো। যেখানে সবাই অগস্ট কিংবা সেপ্টেম্বরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বিসর্জন’-এর বাজনা বাজিয়ে দিয়েছিলেন, এমনকি তাঁর নিজের দলের রাজ্যসভার সাংসদরা তাঁর প্রশাসনের বিরুদ্ধে মিছিল করতে রাস্তায় চলে গিয়েছিলেন কিংবা কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীকে চিঠি লিখে কলকাতার পুলিশ কমিশনারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছিলেন, সেই তৃণমূলকে কীভাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিধানসভার ৬টি উপ-নির্বাচনের ৬টিতেই জিতিয়ে আনলেন? এমনকি উত্তরবঙ্গ, যেখানে বিজেপির ‘শক্ত ঘাঁটি’, সেই মাদারিহাটেও উড়ল ঘাসফুলের পতাকা।
এরপরেও যদি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কোনওদিন না লেখেন ‘জিততে পারি, কিন্তু কেন জিতি’, তাহলে আর কী লিখবেন! আর একইসঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই বিপুল জয় এবং তাদের ‘উপেক্ষা’ করার পর হয়তো ‘বাজারি’ মিডিয়ারও একটা বই করা উচিত, ‘রোজ হারি, কিন্তু তবু কেন দেখাই’! ‘বাজারি’ মিডিয়ার সেইসব টেলিভিশন চ্যানেলগুলি, যারা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ফুঁৎকারে উড়িয়ে দিয়ে নিজেদের ‘মালিক’ বা ‘প্রভু’দের ইচ্ছে অনুযায়ী নতুন সরকার প্রতিষ্ঠা করে দিয়েছিল, শনিবারে বিধানসভার উপ-নির্বাচনের ফলাফল দেখার পরে হয়তো তাদেরও একটু লজ্জা হওয়া উচিত।
৫ই অগস্ট বাংলাদেশের শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটেছিল। হেলিকপ্টারে ঢাকা ছেড়েছিলেন বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী। আর ৯ই আগস্ট আর জি কর-এ এক তরুণী চিকিৎসককে ধর্ষণ এবং খুনের জঘন্য ঘটনা ঘটেছিল। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের বিরোধীরা, অতি উৎসাহী বাম এবং অতি বামেরা এই দুটিকে জুড়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও হাসিনার মতো পশ্চিমবঙ্গ ছেড়ে পালাবেন, এইরকম একটি জল্পনা এবং একইসঙ্গে কল্পনার ফানুস ওড়াতে শুরু করে দিয়েছিলেন।
গত তিন মাসে সোশ্যাল মিডিয়ায় যতরকম ‘মিথ্যে’ দেখা গিয়েছে, মেইন স্ট্রিম টেলিভিশন চ্যানেলে যত ধরনের ‘ভুল তথ্য’ প্রচার করা হয়েছে, তার কোনও উদাহরণ আমার মনে হয় না স্বাধীন ভারতের সংবাদপত্র অথবা সোশ্যাল মিডিয়ায় আছে। ‘১৫০ গ্রাম বীর্য’-এর গল্প থেকে শুরু করে ‘আমি সোমা বলছি’ নামক ‘কাল্পনিক টেলিফোন সংলাপ’ সোশ্যাল মিডিয়ায় ছেড়ে দেওয়া, এই সব কিছুই আমরা হতে দেখেছি।
এবং লেখার শুরুতে যেটা বলেছিলাম, এই টালমাটাল পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের বিভিন্ন ভাইরাল ভিডিও দেখে তৃণমূলের কত নেতাকর্মীই বা রাস্তায় নেমে এই রটনা, জল্পনার প্রতিরোধ করছিলেন? কিন্তু তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, তিনি ছিলেন। কোনও কিছুতে বিচলিত হননি, নেতৃত্ব বদলের ডাক যাঁরা দিয়েছিলেন বা প্রশাসনের বিরুদ্ধে যাঁরা আঙুল তুলেছিলেন, দলের সেইসব নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধেও প্রকাশ্যে কোনও ব্যবস্থা নেননি।
শুধু ধীরে ধীরে বল গড়াতে দিয়েছেন, জল মেপেছেন এবং অবশেষে তিনি এককভাবে কখনও জুনিয়র ডাক্তারদের মঞ্চে পৌঁছে, কখনও নবান্নের সভাঘর থেকে বৈঠক করে বুঝিয়ে দিয়েছেন প্রশাসনের রাশ এখনও তাঁরই হাতে। তৃণমূলের যে রাজ্যসভার সাংসদ, প্রাক্তন আমলা রাজ্যসভার পদে ইস্তফা দিয়ে কলকাতার রাস্তায় মিছিল করতে চলে গিয়েছিলেন। তিনি শনিবার কিছু ট্যুইট করবেন কিনা জানা নেই।
জানা নেই তৃণমূলের সেই রাজ্যসভার সাংসদের কথাও, যিনি প্রকাশ্যে চিঠি লিখে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে রাজ্য প্রশাসনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলেছিলেন। তাঁদের বিরুদ্ধে তৃণমূল নেত্রী কি করেন? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আজীবন রাজনীতিতে উদার থেকে যাওয়া, এঁদের দুজনকেই ক্ষমা করে দিয়েছেন। কিন্তু কেন তিনি ক্ষমা করতে পারলেন, কেন তিনি বারবার জেতেন, কেন টেলিভিশন চ্যানেলের ‘সন্ধেবেলার ডিবেট’ বা খাপ পঞ্চায়েত তাঁর আসনকে টলাতে পারে না, সেটা বোধহয় এবার বোঝবার সময় হয়ে এসেছে।
দুর্ভাগ্যের কথা, কলকাতা বা রাজ্যের তথাকথিত মেইন স্ট্রিম মিডিয়া তাঁর এই সাফল্যের রসায়নকে ঠিক চেনে না। অনেকদিন আগে, সুব্রত মুখোপাধ্যায়, যিনি এক সময় তৃণমূল নেত্রীর ‘রাজনৈতিক গুরু’ ছিলেন, তিনি আমাকে বলেছিলেন, আসলে তৃণমূল দলটা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাঁধের ব্যাগে কিংবা হাতের ডায়েরিতে রয়েছে। একমাত্র তিনিই জানেন, যে দল কোথা থেকে শুরু এবং কোথায় শেষ। এবং কোনওদিন যদি ওই হাতের ডায়েরি বা কাঁধের ব্যাগ হারিয়ে যায়, তাহলে তৃণমূল দলটারও অবলুপ্তি ঘটে যাবে।
এই যে ব্যক্তিগত ‘ক্যারিশমা’ দিয়ে তিনি দলকে চালান, তিনি ৩৪ বছরের বামশাসনকে উপড়ে ফেলে দিয়েছেন এবং নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহদের যাবতীয় ‘বুলডোজার’কে অতিক্রম করে পশ্চিমবঙ্গে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দিয়ে একটা সরকারকে টিঁকিয়ে রাখতে পেরেছেন, সেটার রসায়ন কী সেটা বোধহয় এখনও আমাদের দেশের ‘এলিট’রা, মেইন স্ট্রিম মিডিয়া বোঝে না। বুঝলে বুঝতে পারত, দক্ষিণবঙ্গের হাড়োয়া থেকে উত্তরবঙ্গের সিতাইয়ের সংখ্যালঘুরা কেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিরাপদ আশ্রয় মনে করে ভোট দিয়েছেন।
আড়ালে আবডালে অনেক বিরোধী নেতা স্বীকার করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই এখন শুধু রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নন, তিনিই রাজ্যের প্রধান বিরোধী নেতা। তা নাহলে প্রকাশ্য সভায় রাজ্য পুলিশের সর্বোচ্চ কর্তা রাজীব কুমারকে কেউ ধমক দিতে পারেন? অথবা পুলিশি ব্যবস্থার খোলনলচে বদলে দেওয়ার জন্য দাবি তুলতে পারেন? এই যে নিজের ‘স্ট্রিট ফাইটিং ইমেজ’কে বজায় রাখা, এটাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনীতির সবচেয়ে বড় সাফল্য।
তিনবার মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন, কিন্তু এখনও বোধহয় তিনি তারিক আলির সেই ‘স্ট্রিট ফাইটিং ইয়ারস’ বইটির কথা ভুলতে পারেননি। তিনি জানেন, যে তিনি রাস্তার লড়াইতে এখনও বামেদের তো বটেই, গেরুয়া শিবিরকে বলে বলে গোল দিতে পারেন! তা নাহলে মাদারিহাট, যা ২০১১ থেকে কখনও তৃণমূল জেতেনি, তা-ও এবার তৃণমূলের ঝুরিতে চলে আসবে, যে মাদারিহাটে ২০১৬ থেকে আরএসএসের ‘পোস্টার বয়’ মনোজ টিগ্গা জিতে আসছেন, উত্তরবঙ্গের সেই চা-বাগানেও এবার তৃণমূলের পতাকা উড়বে!
এই যে সাফল্যের রসায়ন, বা কখন কোন সময় কোন ওষুধটা প্রয়োগ করতে হয়, সেটা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘রাস্তার রাজনীতি’ দিয়ে বুঝেছেন। এবং যখন তাঁর পাশে কেউ নেই, তখনও তিনি এটা করতে পারেন, নন-স্ট্রাইকার এন্ডে কে আছেন তার দিকে না তাকিয়েও তিনি অবলীলায় কপিল দেবের সেই এজবাস্টানের ১৭৫ রানের মতো একটা ইনিংস খেলে বেরিয়ে যেতে পারেন। যে ইনিংস দলের অন্যদের উদ্বুদ্ধ করবে এবং বুঝিয়ে দেবে যে এভাবেও ম্যাচে ফিরে আসা যায়! আর জি কর কাণ্ডের পর যাঁরা তাঁর রাজনৈতিক ‘অবিচুয়ারি’ লিখে দিয়েছিলেন, তাঁরা শনিবার কী করবেন সেটা ভেবেই মজা লাগছে।
২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের ‘আকাশচুম্বী’ সাফল্য দেখিয়েছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কতটা সাহসী বা তিনি কীভাবে উগ্র হিন্দুত্বের মোকাবিলা করতে পারেন। শনিবার বিধানসভার উপ-নির্বাচনের ফলাফল বলে দিল, যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গের হৃদয়কে চেনেন, গ্রাম বাংলার মানুষদের চরিত্রকে বোঝেন। এবং যতই তথাকথিত ‘এলিট’, যে কলেজে আমি পড়েছি সেই প্রেসিডেন্সি, যাদবপুরের ‘নাক উঁচু’ ভদ্রলোকরা তাঁকে ‘ভিক্ষার রাজনীতি করছেন’ বলে ব্যঙ্গ করুন, আসলে ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’ থেকে বিভিন্ন সোশ্যাল বেনিফিসিয়ারি তৈরির প্রকল্পই তৃণমূলের ‘তুরুপের তাস’।
এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই ‘ডাইরেক্ট বেনিফিশিয়ারি’ তৈরি করার মডেলকে এখন গোটা ভারতবর্ষ অনুসরণ করছে।
কিন্তু শনিবারে উত্তুঙ্গ জয়ের পরেও তৃণমূল যেন ‘আত্মতুষ্ট’ না হয়ে পড়ে। কারণ বিজেপি তার দাঁত, নখ বের করবেই। আবার বিধানসভা নির্বাচনের আগে সাম্প্রদায়িক উস্কানি আসবে। এবং পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যার অনুপাতে যেহেতু সংখ্যালঘুরাও প্রায় ২৭ শতাংশ, তাদের উপস্থিতিকে ব্যবহার করে উগ্র হিন্দুত্ববাদকে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করা হবে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যক্তিগত ‘ক্যারিশমা’, কর্মকুশলতা, এবং বাংলার মাটিকে চেনার প্রবণতাকে দিয়ে একক দক্ষতায় সেই সব কিছুকে এখনও আটকাচ্ছেন। কিন্তু দল হিসেবে তৃণমূলকে তৈরি হতে হবে। বুঝতে হবে, যে বিজেপির সঙ্গে মোকাবিলায় কীভাবে তৃণমূল নিজের ঘুটি সাজাবে? কীভাবে প্রশাসন এবং দলের আরও স্বচ্ছ ভাবমূর্তি তৈরি করে তোলা যাবে। দলে কিছু ‘আয়ারাম-গয়ারাম’ সবসময় থাকবেন। তাঁরা ক্ষমতার লোভে কখনও রাজ্যসভার সাংসদ হবেন, আবার কখনও দলের বিপদের দিনে বিবৃতি দিয়ে দল ছাড়বেন। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যাকে সামনে রেখে এগিয়ে চলার জন্য তৃণমূলের একটা সুস্পষ্ট নীতি এবং কাঠামো দরকার।