
The Truth of Bengal,mou Basu: কথায় বলে বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ। ক’দিন পরেই আরেক উৎসব বিশ্বকর্মা পুজোয় মেতে উঠবে উৎসবপ্রিয় বাঙালি। বাঙালি সংস্কৃতিমনস্ক জাতি হলেও কলকারখানা, ছাপাখানা, রিক্শা স্ট্যান্ড, অটো স্ট্যান্ড, প্রিন্টিং প্রেস-সহ বিভিন্ন জায়গায় জাঁকজমকপূর্ণ ভাবে দেবতাকূলের প্রযুক্তিবিদ হিসাবে পরিচিত বিশ্বকর্মার পুজোর প্রচলন আছে। সব পুজোই তিথি নক্ষত্র মেনে করা হয়। তবে প্রত্যেক বছর পুজোর তিথি একইদিনে পড়ে না। বিশ্বকর্মা পুজোর এব্যাপারে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আছে। প্রত্যেক বছর ভাদ্র সংক্রান্তির দিন সাড়ম্বরে পূজিত হন বিশ্বকর্মা। সাধারণত ১৭ সেপ্টেম্বর হয় বিশ্বকর্মা পুজো কিন্তু কোনো কোনো বছর ১৮ সেপ্টেম্বরও পড়ে বিশ্বকর্মা পুজো। যেমন এবছর ১৮ সেপ্টেম্বর হবে বিশ্বকর্মা পুজো। বিশ্বকর্মা পুজোর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে আরেক লৌকিক আচার। বিশ্বকর্মা পুজোর দিন এদেশীয়দের বাড়িতে “অরন্ধন” বা রান্না পুজো পালিত হয়। দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় সাড়ম্বরে পালিত হয় রান্না পুজো।অরন্ধন কথার আভিধানিক অর্থ অ রন্ধন বা যেদিন রান্না করা হয় না বা রান্না করা নিষেধ।যেদিন পুজো হয় সেদিন অর্থাৎ বিশ্বকর্মা পুজোর দিন বাড়িতে কোনো রকম রান্না হয় না। তাই এর নাম অরন্ধন। ভাদ্র সংক্রান্তির আগেই রান্নাঘর পরিষ্কার করা হয়। আগে মাটির উনুন নতুন ভাবে সাজানো হত। এখন মাটির উনুনের প্রচলন নেই। আধুনিকতার হাত ধরে বাড়িতে বাড়িতে এখন গ্যাসস্টোভ, মাইক্রো ওভেন, ইনডাকশনের ছড়াছড়ি।
সে সবও রীতিনীতি মেনে পরিষ্কার করা হয়। বাড়িতে পরিবারের কল্যাণকামনায় মনসা গাছের সামনে থালায় পঞ্চব্যাঞ্জন সাজিয়ে পুজো করা হয়। এদিন অষ্টনাগের পুজো করা হয়। গৃহিণীরা পরিজনদের কল্যাণকামনায় শিবের মানসপুত্রী মনসাদেবীর উদ্দেশ্যে নানাবিধ পদ রান্না করে নিবেদন করেন। মনে করা হয়, ভরা বর্ষায় যাতে কাউকে সাপে না কাটে তাই সর্পদেবী মনসাকে তুষ্ট করতে অষ্টনাগের পুজো করা হয়।রান্নাপুজোয় উনুনের পুজো করা হয়। সারা বছর আমরা যে উনুন বা গ্যাসস্টোভ বা মাইক্রোওভেনে, ইনডাকশনে রান্না করি তার উপাসনা করা হয় এই পুজোয়। উনুনের গর্ত হল মা মনসার প্রতীক। তাই দেবী মনসার উদ্দেশ্যে পুজো বোঝাতেই উনুন পুজো করা হয়।দেবী মনসা বাংলার লৌকিক দেবদেবীর মধ্যে অন্যতম। ভরা বর্ষা কাটিয়ে যখন সূর্যের আলো ভূমি স্পর্শ করে, শীতকালের শীতঘুম কেটে ঘুম কেটে যাওয়ার আগে গ্রামাঞ্চলে সাপের আনাগোনা শুরু হয়। অনেক সময় সাপের কামড়ে জীবনহানিও ঘটে। তাই মনসাদেবীকে সন্তুষ্ট রাখতে সংসারজীবনে দেবীর কৃপালাভের আশায় আগের দিনের রান্না করা বিভিন্ন রকমের পদ সাজিয়ে দেবীকে নিবেদন করা হয়। গ্রামে দৈনন্দিনের রান্না হয় যেখানে সেই উনুন গোবর জল দিয়ে পরিষ্কার করে আলপনা দিয়ে মনসা পাতা দিয়ে সাজিয়ে ঘট প্রতিষ্ঠা করে পুজো করা হয়। রান্না পুজোর দিন বাড়িতে টাটকা রান্নার নিয়ম নেই। আগের দিন রাতেই সব রান্না করে রাখা হয়। ভাত ফুটিয়ে, ঠান্ডা করে তাতে জল ঢেলে পান্তা করে রাখা হয়। খাদ্যরসিক বাঙালির খাবার পাতে নানারকম সুস্বাদু পদ না হলে চলে না। উৎসব পার্বণে তো তা আরো বাধ্যতামূলক।রান্নাপুজো এর ব্যতিক্রম নয়। কথায় বলে “পচা ভাদ্র”। ভাদ্র মাসে কখনো ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি আবার কখনো ভ্যাপসা গরম। এরসঙ্গে সঙ্গত করে আবার চাঁদিফাটা রোদ। ভাদ্র মাসে কড়া রোদের কারণে পিত্তক্ষরণ বেশি হয়। শরীর গরম হয়ে যায়। গ্রামের মানুষ তাই রোদ থেকে বাঁচতে এই রকম খাবার খান। আবহাওয়ার খামখেয়ালিপোনা থেকে বাঁচতেই এই সময় পান্তা খাওয়া হয়।
এরসঙ্গে থাকে আলু, ঢ্যাঁড়শ, চিচিঙ্গে, বেগুন, নারকেল, কাঁচকলা, পটল, উচ্ছে, কুমড়ো-সহ প্রায় ১০ রকম ভাজা। নারকেল কুচি দিয়ে খেসারি বা মুসুর বা মটরডাল। আহা! তার স্বাদ যেন অমৃত।এদিন পারিবারিক প্রথা অনুযায়ী, কারোর বাড়িতে নিরামিষ আবার কারোর বাড়িতে আমিষ পদ রান্না করা হয়। কারোর বাড়িতে কুচো চিংড়ি মাছ ও বরবটি দিয়ে তরকারি রান্না করা হয়। এদেশীয়দের বাড়িতে সেভাবে কচুরলতি বা কচুশাক খাওয়ার চল নেই। অরন্ধন উপলক্ষ্যে এদেশীয়দের বাড়িতে কচুশাক বা কচুরলতি রান্না করা হয়। আবার কারোর বাড়িতে কচুশাকের ঘণ্ট। কারোর বাড়িতে আবার কলমি, নটেশাকের ঘণ্টও রাঁধা হয়ে থাকে। এরসঙ্গে আমিষ পদ হিসাবে থাকে রুই বা কাতলামাছের কালিয়া, চিংড়ি মাছের মালাইকারি। কারোর বাড়িতে আবার সর্ষেবাটা দিয়ে ইলিশ মাছের পদ রান্না করা হয়। অনেকে তো আবার ৪-৫ রকমের মাছের পদও রান্না করা হয়। একেবারে শেষ পাতে থাকে চালতার চাটনি। কেউ আবার মিষ্টি কুমড়ো, তেঁতুল দিয়েও চাটনি রাঁধেন। মধুরেণসমাপয়েৎ ছাড়া বাঙালির ভোজন অসম্পূর্ণ। তাই মিষ্টির পদ হিসেবে থাকে পাকাকলার বড়া, মালপোয়া, নারকেলের ছাপা, গোবিন্দভোগ চালের পায়েস।প্রত্যেক বাড়িতে পারিবারিক ঐতিহ্য মেনে রান্না করা হয়। কারোর বাড়িতে আগের দিন রাতে আবার কারোর বাড়িতে আগের দিন সন্ধ্যা থেকে রান্না শুরু হয়। ওইদিন রাতে বাড়ির গিন্নি উপোস করেন। পাটভাঙা শাড়ি পরে বাস্তুদেবীর উদ্দেশ্যে প্রণাম জানিয়ে রান্না শুরু করেন। রান্না শেষে রান্নাঘর বা ঠাকুরঘরের সামনে রান্না করা পদগুলো নৈবেদ্য হিসাবে সাজিয়ে দেওয়া হয়। বিশ্বকর্মা পুজোর দিন মনসা গাছের সামনে চিঁড়ে, দুধ, ফল, মিষ্টি নৈবেদ্য হিসাবে সাজিয়ে দেওয়া হয়।