
The Truth of Bengal, Mou Basu : আশ্বিনের শারদপ্রাতে আলোক মঞ্জির বেজে উঠতে এখন মাস খানেকেরও বেশি সময় বাকি। কিন্তু নীল আকাশে পেঁজা তুলোর মতো মেঘের ভেলার আনাগোনা আর মাঝেমধ্যে ঝেঁপে বৃষ্টি জানান দিচ্ছে শরৎকাল এসে গেছে। রাস্তায় রাস্তায় বাঁশের ম্যারাপ বাঁধা, জামাকাপড়, গয়নার দোকানে, জুতোর দোকানে, শপিং মলের ভিড়ে স্পষ্ট বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব যা আজ কার্নিভালের রূপ নিয়েছে সেই দুর্গোৎসব আসন্ন। চূড়ান্ত প্রস্তুতিতে মগ্ন পুজো কমিটিগুলোও। উত্তর হোক কিংবা দক্ষিণ কলকাতার বিভিন্ন পুজো কমিটি প্রতিবছরই নজরকাড়া থিমে একে অপরকে টেক্কা দেয়। অভিনব থিমে কে কত বেশি লোক নিজের প্যান্ডেলে টানতে পারবে এনিয়ে প্রতিনিয়ত তাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলে। যেমন দক্ষিণ কলকাতার ঐতিহ্যশালী পুজো “শিবমন্দির”-এর এবার ৮৭তম বছরের থিম “আগল”। সামগ্রিক সৃজনে রয়েছেন নবীন থিমমেকার সূচনা। প্রতিমা গড়ছেন দীপঙ্কর পাল। আলোর দায়িত্বে রয়েছেন বিখ্যাত শিল্পী প্রেমেন্দু বিকাশ চাকি। সহযোগী হিসেবে আলোর দায়িত্বে রয়েছেন সুশান্ত হালদার। থিমের পুজোয় অভিনব প্যান্ডেল ও প্রতিমার সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে আলোর ভূমিকা যেমন অনস্বীকার্য তেমনই সমান গুরুত্বপূর্ণ হল সঠিক আবহের ভূমিকাও। এবছর শিবমন্দিরের পুজোর আবহের দায়িত্বে রয়েছেন বিখ্যাত সুরকার জয় সরকার। থিমের গ্রন্থনার দায়িত্বে রয়েছেন বিখ্যাত সাংবাদিক দেবদূত ঘোষঠাকুর, যিনি প্রায় ৪ দশক সাংবাদিকতার পেশায় রয়েছেন। পেশা সাংবাদিকতা ও অধ্যাপনা হলেও নেশা তাঁর পুজো। সাড়ে ১৬ বছরের বেশি সময় ধরে দক্ষতার সঙ্গে আনন্দ বাজার পত্রিকার চিফ রিপোর্টারের দায়িত্ব সামলেছেন দেবদূতবাবু। আনন্দ বাজার থেকে অবসর নিলেও সাংবাদিকতার জগৎ থেকে অবসর নেননি। অধ্যাপনার গুরু দায়িত্ব সামলেও এখনো নিয়মিত লেখালেখি করেন। প্রতিবছর পুজোর কাজেও সমানতালে যুক্ত থাকেন।
শহরের পুজো পাগল কর্মকর্তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন শিবমন্দিরের পার্থ ঘোষ। শিবমন্দির সর্বজনীন দুর্গোৎসব সমিতির ৮৭তম বছরের থিম “আগল”। পার্থবাবুর কথায়, ” মায়ের আঁচলের আড়ালে শিশুরা সব সময় সুরক্ষিত, নিরাপদ বোধ করে। কারণ, মায়ের আঁচল শিশুকে সব বিপদ থেকে আগলে রাখে। রোদ, বৃষ্টি, ঝড়ঝাপ্টা সবকিছু হেলায় রুখে দেয় মায়ের আঁচলের আগল। শিশুর মতোই বাড়ির সদর দরজা বন্ধ থাকলে নিজেকে সুরক্ষিত মনে করে গৃহস্থ। কারণ সদর দরজার আগল সরলেই নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে। আবার প্রদীপের অনির্বাণ শিখাকে জ্বলতে সাহায্য করে মাটির সরা। ঠিক একইভাবে মেঘের আগল ভেঙে সূর্য যখন বেরিয়ে আসে তখন আলোকিত হয়ে ওঠে চারিপাশ। তেমনই দুর্গতিনাশিনী, অসুরদলনী সর্বমঙ্গলা মা দুর্গা অশুভশক্তি, সব দুষ্টের সামনে আগল তুলে দেন বলেই আমরা সবচেয়ে নিরাপদ বোধ করি। এবারের থিমের মাধ্যমে আমরা এই বার্তা দিতে চলেছি।”বিখ্যাত থিম শিল্পী বিমল সামন্তর কন্যা সূচনা রয়েছেন এবছর শিবমন্দিরের পুজোর সৃজনের দায়িত্বে। তাঁকে যোগ্য সঙ্গত করছেন দীপঙ্কর পাল। তিনি গড়ছেন প্রতিমা। বিখ্যাত সিনেম্যাটোগ্রাফার প্রেমেন্দু বিকাশ চাকি রয়েছেন আলোর দায়িত্বে। সহযোগী হিসেবে রয়েছেন সুশান্ত হালদার। সূচনা থিম প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে জানান, “আজকের দিনে চারিদিকে প্রতিযোগিতা চলছে অনবরত। প্রতিযোগিতামূলক সমাজ ব্যবস্থায় আমরা প্রত্যেকেই নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। সব সময় প্রকৃত অভিভাবকের অভাব অনুভব করছি। এমন একজন অভিভাবক যিনি আমাদের সবাইকে সব সময় আগলে রাখবেন। কিন্তু আমাদের চিন্তা কীসের? কারণ, আমাদের সঙ্গে রয়েছেন স্বয়ং মা দুর্গা। তিনি আমাদের প্রতিনিয়ত আগলে রাখেন। এই ভাবনা থেকেই এবারের থিম ” আগল”। খিল কথার আক্ষরিক অর্থ হচ্ছে আগল। যা আগলে রাখার কথা বলে, সংরক্ষণ করার পথ দেখায়। প্রকৃতিও আমাদের সব সময় পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ ভাবে আগলে রাখে। ঘরকে সুরক্ষিত রাখতে আমরা খিল বা ছিটকিনি দিই।
এছাড়া আমরা যে বিভিন্ন রকমের মাটির পাত্র দেখি। তা ঢাকা দেওয়ার জন্য ব্যবহার করা হয় মাটিরই তৈরি সরা। মাটির সরা ব্যবহার করা হচ্ছে মণ্ডপসজ্জায়। আমরা আমাদের শরীর ঢাকতে পোশাক আবরণ হিসাবে ব্যবহার করি। তেমনই গোটা বিশ্বই ঢাকা রয়েছে মাটি দিয়ে। জল সংরক্ষণের বার্তা দিতে, প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষা করতে মাটির তৈরি জিনিস ব্যবহার করা হচ্ছে মণ্ডপ নির্মাণে। মাটির নিজস্ব রঙের পাশাপাশি ভেষজ বিভিন্ন রঙ ব্যবহার করা হচ্ছে। মণ্ডপও মাটির হচ্ছে। মা দুর্গা আমাদের আগলে রাখছেন এরকম আদলেই প্রতিমা গড়া হচ্ছে।”১৯৩৬ সালে রবীন্দ্র সরোবরের কাছে লেক টেম্পল রোডের কয়েকজন বাসিন্দা মিলে দুর্গাপুজো শুরু করেন। নাম দেওয়া হয় “শিবমন্দির সর্বজনীন দুর্গোৎসব সমিতি”। আজ সেই পুজোর নাম ছড়িয়ে পড়েছে ব্যাপক আকারে চারিদিকে। এখন পুজোর ক’দিন ব্যাপক জনসমাগম হয় দক্ষিণ কলকাতার অন্যতম বড়ো পুজো শিবমন্দিরের পুজো প্রাঙ্গণে। ১৯৯৯ সালে কলকাতার দুর্গাপুজোয় হইচই ফেলে দেয় শিবমন্দির। থিম হিসাবে বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরের টেরাকোটা শিল্পকে তুলে ধরা হয়। নানান বছরে অভিনব সব থিম তুলে ধরে ৪ বার এশিয়ান পেইন্টস শারদ সম্মান, আনন্দ অর্ঘ্য, ইমপ্যাক্ট শারদ অর্ঘ্য, ট্রু স্পিরিট পুজো, সংবাদ প্রতিদিন পূজা পার্ফেক্ট পুরস্কার জিতেছে শিবমন্দির। এছাড়াও একাধিক বার জিতেছে সরকারি বিশ্ববাংলা ও কলকাতা শ্রী পুরস্কার। পুজোর পাশাপাশি সারা বছরই নানান সামাজিক কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত শিবমন্দির সেবা প্রতিষ্ঠান। এলাকার গরিব শিশুদের জন্য বিকেলে অবৈতনিক স্কুল চালানো হয়। সপ্তাহে ৬ দিন ক্লাস হয়। ৯০ জন পড়ুয়া আছে। বইখাতা, স্কুলের পোশাক, টিফিনও দেওয়া হয় পড়ুয়াদের। প্রথাগত পড়াশোনার পাশাপাশি কম্পিউটার, আঁকা, নাচ ও কারাটেও শেখানো হয়। পড়ুয়াদের স্বাস্থ্যের খেয়াল রাখতে সপ্তাহে ২ দিন চেকআপ করেন ২ হোমিওপ্যাথি ডক্টর।