
The Truth of Bengal: ভোজনরসিক বাঙালির খাবারের তালিকা সুদীর্ঘ। কি নেই সেখানে! টক থেকে মিষ্টি, তেতো থেকে ঝা্ল, চচ্চড়ি। আর তাইতো কলকাতার অলিগলিতে ছড়িয়ে রয়েছে বাঙালির নস্টালজিয়া। কফি হাউসের গল্পের আড্ডায় কফি হাতে তুফান তোলা হোক কিংবা সাহেবি ঢঙে পিটার ক্যাটের সিজলারের ধোঁয়ায় শনিবাসরীয় সন্ধ্যার মওতা। কিন্তু আপনি কি জানেন এই সমস্ত নস্টালজিয়ার সঙ্গেই জড়িয়ে রয়েছে এক সুদীর্ঘ ইতিহাস। আপনাদের জন্য আমাদের এই পর্বে প্রতিদিনই থাকবে সেই সমস্ত ইতিহাসের কিছু টুকরো সন্ধান।
ওর বাবা খুব খারাপ।
আজ ও আমাকে ধরে খুব কড়কেছে। বলেছে, আর আমার মেয়ের সঙ্গে মিশবে না। এই বাড়ির সামনে যেন না দেখি।
কেন? কী হয়েছিল আজ?
গাড়ি বারান্দার নীচে দাঁড়িয়ে চুমু খাচ্ছিলাম।
কচুরি ডালে ভিজিয়ে মুখে ঢোকাতে গিয়ে আমি একটু বিষম খেয়ে গিয়েছিলাম। প্রেসিডেন্সি কলেজের আমার সহপাঠী অবশ্য নির্বিকার মুখে ল্যাংচা খাচ্ছিল।
বলিস কী! তাহলে?
ভাবছি বিয়ে করে নেব। রেজিস্ট্রি বিয়ে। তোরা সাক্ষী দিবি তো? টেবিলে বসা আমরা বাকি সবাই চুপ। এখন আর ঠিক মনে নেই মৌচাকের কচুরি আর ছোলার ডাল ছেড়ে কে প্রথম গিয়েছিল কফি হাউসে ম্যারেজ রেজিস্ট্রারের অফিস থেকে ফর্ম তুলতে।
এই কলেজ স্ট্রিটের মৌচাকে ব্রেকফাস্ট করতে ঢুকে আমার মগজে তিরিশ বছর আগের সব স্মৃতি হুড়মুড়িয়ে ফিরে এলছোলার ডালে কচুরি ডোবাতে গিয়ে একবার পিছনের টেবিলের দেখে নিলামওরাও কি এখনও চুমু খেতে গিয়ে ধরা পড়ে? বাড়িতে না জানিয়ে রেজিস্ট্রি করতে যায়? এক টেবিলের সবাই মিলে বন্ধুর বিয়েতে সাক্ষী হয়?
সূর্য সেন স্ট্রিট ধরে হাঁটতে হাঁটতে সকালে মৌচাকে ঢুকে কচুরি খেতে গিয়ে আসলে আমি অনেক বছর পিছিয়ে। কলেজ স্ট্রিটের যে-পাড়ায় আমাদের শৈশব, কৈশোর এবং যৌবনেরও অনেকদিন কেটেছে, সেই পাড়ায় ফিরে যাওয়া মানেই আসলে ডাউন মেমোরি লেন দিয়ে হাঁটা। নস্টালজিয়ার মিঠে আঁচে জীবনকে একটু সেঁকে নেওয়া। কলেজ স্ট্রিট আমাদের যত কমরেডারি শিখিয়েছিল, তার অনেক কিছুরই তো গোড়াপত্তন হয়েছিল মৌচাকের টেবিলে কিংবা চাচিংড়ি আর চুমু… মৌচাক বসন্ত কেবিনের ভিতরে। এখানেই তো প্রেমের হাতেখড়ি কিংবা ঘৃণারও।
তাই প্যারামাউন্টে যেমন গিয়ে কখনও জিজ্ঞেস করতে নেই শরবতের দাম কি মুদ্রাস্ফীতির প্রাইস ইনডেক্স অনুযায়ী বেড়েছে, তেমনই বসন্ত কেবিনের ফিশ ফ্রাইতে কামড় দেওয়ার সময় মাছটা ভোলা ভেটকি আসল ভেটকি সেটাও জিজ্ঞেস করতে নেই। কারণ খাওয়াটা আসল নয়, চাখাটা মূল উপপাদ্য। আমার মতো পঞ্চাশে পা দিতে চলা বৃদ্ধের জন্য তো বটেই, হয়তো যে তরুণ মতো কলেজ স্ট্রিটে পা দিতে এল তার জন্যওগত তিরিশ বছরে এই শহর আড়ে এবং বহরে যতটা বেড়েছে, তাতে নিশ্চয়ই গড়িয়া থেকে গড়পারে মিষ্টির দোকান অনেক হয়েছে। এবং সেখানে কচুরিও ভাজে। কিন্তু সেই গত শতকের ৬-এর দশক থেকে তো কেউ আর মৌচাকে বা পুঁটিরামে শুধু কচুরি খেতে আসেনি টেবিলে বসে নিজের মতো করে, নিজেদের মতো করে ‘হাম দেখেঙ্গে’ গাইতে শিখেছে, উচ্চারণ করতে শিখেছে।
এটাই কলেজ স্ট্রি। এটাই কলেজ স্ট্রিটের। প্রেমে এবং অপ্রেমে বাঁচতে শেখায়। চুমুতে এবং চিংড়ির কাটলেট এ জীবনকে চিনতে শেখায়। মৌচাকে বসে ছোলার ডালচাখতে চাখতে আমার কলেজের সব স্মৃতি মনে পড়ে গেলঅক্লেশে এবং অনায়াসে চুমু দিয়ে বান্ধবীকে বিদায় জানাতে অভ্যস্ত যুবক বলিউডে নাম করেছে, মধ্য যে গাড়ি বারান্দার নীচে দাঁড়িয়ে এইসব কীর্তি করত, সেই বাড়িও এখন বিক্রি হয়ে গিয়ে ডায়াগনস্টিক সেন্টার। কফি হাউসের আড্ডার মতো মৌচাকের টেবিলের বাকি সবাইয়ের মধ্যে কেউ দেশে, কেউ প্যারিসে। হারিয়ে যাওয়া বন্ধুত্ব আর ফেলে আসা দিনগুলোকে খুঁজতে আমরা কেউ কখনও কলকাতায় ফিরি। এবং মৌচাকে এসে ল্যাংচা খেতে খেতে দেখি এখনও কারা জেরক্স সেন্টারে আসে, এই প্রজন্মের লিঙ্গোকে চেনার চেষ্টা করি।এর পরেও যদি কেউ শুধু খাওয়ার কথা জানতে চান তাহলে বলব কচুরির পরে চমচমটা মাস্ট। তারপরে ল্যাংচাও খেতেই হবে।