
The Truth of Bengal: সারা বিশ্বে এখনও পর্যন্ত হাতে গোনা মাত্র কয়েকটি মহাকাব্য রয়েছে। তার মধ্যে অবশ্যই অন্যতম রামায়ণ এবং মহাভারত। এ ছাড়া রয়েছে ইলিয়াড ওডিশি। বিতর্ক রয়েছে, এই মহাকাব্যগুলি কি নিছক কাল্পনিক ঘটনাপ্রবাহ নাকি এর মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে কোনও ইতিহাস। বিতর্ক রয়েছে পণ্ডিতদের মধ্যে। একাংশ মনে করেন মহাকাব্যগুলি জলজ্যান্ত ঐতিহাসিক দলিল, কারণ তার সূত্র, প্রমাণ অনেক কিছুই জনমানসের সামনে উঠে এসেছে সময়ের হাত ধরে। রামায়ণ, মহাভারতের মতো একই বিতর্ক ছিল হোমারের লেখা ইডিয়াড ওডিশিকে ঘিরে।
একটা সময় গিয়েছে পাশ্চাত্যের ঐতিহাসিক গবেষকরা মেনে নিতে পারেননি, ইলিয়াড ওডিশি মহাকাব্যের মধ্যে কোনও ঐতিহাসিক উপাদান রয়েছে বলে। কারণ, যে ট্রয় নগরীর কথা বলা হয়েছে, তার কোনও সূত্র সন্ধান মেলেনি। যদিও, আধুনিক সময়ে দাঁড়িয়ে সময়ের হাত ধরে মাটি ফুঁড়ে উঠে আসছে একের পর এক প্রাচীন স্থাপত্য। আর সেই স্থাপত্যের বিস্তারিত খোঁজ খবর চালাতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে, তথ্য, সূত্র অনেকটাই মিলে যাচ্ছে মহাকাব্যের সঙ্গে। সূত্রটা মিলেছে তুরস্কের ভূমি পুনর্জন্ম নেওয়া প্রাচীন ট্রয় নগরীর খোঁজে। এ এক অন্য ইতিহাস, এখন ফিরে দেখা যাক, ট্রয় নগরীর যুদ্ধের ইতিহাসকে।
সহস্রাব্দ প্রাচীন এশিয়া মহাদেশের বুকে ছিল এক রাজ্য নাম ট্রয়। যাঁর খোঁজ মিলেছে অধুনা তুরস্কের আনাতোলায়া রাজ্যে। এই রাজ্যের রাজা ছিলেন প্রিয়াম ও রানি হেকবা। তাঁদের একমাত্র পুত্র ছিল, নাম প্যারিস। রাজপুত্র প্যারিস যখন যুবক, তখন স্পার্টা রাজ্যের রাজা মেনেলাসের স্ত্রী হেলেনের প্রেমে পড়েন তিনি। প্যারিস, প্রেম নিবেদন করে হেলেনকে নিয়ে ট্রয়ে পালিয়ে আসেন। এর ফল দাঁড়ায় মারাত্মক। ট্রয় ও স্পার্টা রাজ্যের মধ্যে শুরু হয় যুদ্ধ। কাহানি এতোটাই চমকপ্রদ ও রোমাঞ্চকর যে গ্রিক ও রোমান সাহিত্যেও বড় জায়গা করে নেয় ট্রেয়ের যুদ্ধ। প্রথমে মহাকাব্য রচনা করেন হোমার। পরবর্তী সময়ে বহু প্রাচীন সাহিত্যিক নানা প্রাচীন গল্প কাহানির জন্ম দিয়েছেন। সেই সব সাহিত্যিকদের মধ্যে অন্যতম হেরোডেটাস, সফোক্লেস, রোমান কবি ভার্জিল ও ওভিড।
কারণ ছিল অত্যন্ত স্পষ্ট, প্যারিস অন্য রাজ্যের রানিকে তুলে নিয়ে আসবেন আর সেখানে যুদ্ধ হবে না একি হয়! আগেই বলেছি, এ কোনও অপহরণের কাহিনি ছিল না, নিছকই এক প্রেমের কাহিনি। প্যারিসের প্রেমের টানেই হেলেন স্পার্টা ছেড়ে পালিয়ে আসেন, তিনি জানতেন, ফল কী হতে চলেছে, তবুও তিনি চলে আসেন।
হোমারের লেখনীতে মূল যে বিষয়বস্তু ছিল, প্যারিস ও হেলেনের প্রেমের কাহানি। এবং ভবিষ্যত চিন্তা না করেই, প্রেমে অন্ধ হয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার উদাহরণ তৈরি করেছিলেন। স্পার্টার রাজা সর্বশক্তি দিয়ে আক্রমণ চালায় ট্রয়ের উপর। টানা দশ বছর ধরে নাছোড়বান্দার মতো যুদ্ধ চালিয়ে যায় স্পার্টা। এর ফলে পুরো ট্রয় নগরী ধ্বংস হয়ে যায়। আসলে এই যুদ্ধের কাহিনির অন্তরালে আরও এক মূল গর্ভাঙ্ক কাহিনি লুকিয়েছিল। গ্রিক পৌরাণিক কাহিনিতে বলা হয়েছে, পৃথিবীতে মানব জাতির সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছিল, ফলে চিন্তায় ছিলেন প্রধান দেবতা জিউস। তিনি চেয়েছিলেন, জনসংখ্যা কমাতে, তাই জনসংখ্যা কমানোর একমাত্র রাস্তাই হল যুদ্ধ। সেই চিন্তা থেকেই দেবতারা মানবজাতির ভবিত্যে ট্রয় যুদ্ধের চিত্রনাট্য লিখেছিলেন।
গ্রিসের পৌরাণিক কাহিনি মতে, একবার স্বর্গে তিন দেবীর মধ্যে ঝগড়া শুরু হয়। তিন দেবী হলেন, এথেনা, হেরা ও আফ্রোদিতি। এরিস নামে এক দেবী, এই তিন দেবীর মধ্যে দ্বন্দ্বের সূচনা করেন। গ্রিক পৌরাণিক কাহিনি পড়লে জানা যায়, এরিস ছিলেন ঝগড়া, গণ্ডগোল পাকানোর দেবী। এরিস তিনদেবীকে একটি সোনার আপেল দেন, সেই আপেলে লেখা ছিল, এটি শ্রেষ্ঠ সুন্দরীর জন্য। তিন দেবীই নিজেদের সুন্দরী বলে আপেলের দাবিদার হলেন। শ্রেষ্ঠ সুন্দরী দেবীকে বেছে নিতে হবে, বিচার করার দায় বর্তাল দেবতাদের উপর। কিন্তু কোনও দেবতা সাহস করে সিদ্ধান্ত প্রকাশ্যে জানাতে পারলেন না। অগত্যা দেবতাদের প্রধান জিউস, সিদ্ধান্ত নিলেন বিচারের ভার দেওয়া হবে মানবজাতির কাউকে। বাছাই করা হল, প্যারিসকে। ট্রয় নগরের রাজপুত্র।

প্যারিস দেবলোকের তিন দেবীর মধ্যে শ্রেষ্ঠ সুন্দরী হিসেবে বেছে নিলেন আফ্রোদিতিকে। তিনি অত্যন্ত প্রসন্ন হয়ে প্যারিসকে বর দেন। আফ্রোদিতি বললেন, মর্ত্যেলোকের শ্রেষ্ঠ সুন্দরী হবে তোমার ভালোবাসার পাত্রী। বলা বাহুল্য সেই সময় পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুন্দরী ছিলেন হেলেন। যদিও তিনি ছিলেন স্পার্টারাজের রানি। দেবীর বর পাওয়ার পর দেখা গেল, হেলেন প্রেমে পড়লেন প্যারিসের। একদিন হেলেন স্পার্টা সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে প্যারিসের সঙ্গে পাড়ি দিলেন ট্রয় নগরীতে।
এই সংবাদ দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ল স্পার্টা রাজ্যে। প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হলেন রাজা মেনেলাস। ট্রয়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে দিলেন। টানা ১০ বছর ধরে যুদ্ধ চালিয়ে গেলেন মেনেলাস। এদিকে, যুদ্ধে বিধ্বস্ত হওয়ার পরেও, ট্রয় নগরীর বাসিন্দারাও হেলেন ছাড়তে চাইল না। কড়া প্রতিরোধ গড়ে তুললো তারা। কিন্তু স্পার্টার প্রবল পরাক্রম লড়াই চালিয়েও ট্রয় নগরীকে জয় করতে পারছিল না। অগত্যা গ্রিকরা এক ছলের সাহায্য নিল।
আরও পড়ুন- ইতিহাসের পাতা থেকে হারিয়ে যাওয়া এক ভারতীয় বীরের কাহিনি
ট্রয় নগরীর বাইরে এক বিশালাকার ঘোড়া রেখে চলে যায়। বেশ কয়েকদিন অপেক্ষার করে ট্রয়ের সৈন্যরা খেয়াল করে, দুর্গের বাইরে স্পার্টার সৈন্যরা নেই, কিন্তু সেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে, প্রকাণ্ড এক কাঠের ঘোড়া। তারা মনে করল, স্পার্টার রাজা হার স্বীকার করে এই ঘোড়াকে উপহার দুর্গের সামনে রেখে দিয়ে গেছে। ট্রয়ের সৈন্যরা, ঘোড়াটিকে দুর্গের মধ্যে নিয়ে আসে। এরপরেই, ঘোড়া থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে স্পার্টার সৈন্য বেরিয়ে বিধ্বংসী যুদ্ধ শুরু করে। যাকে সামনে পায় তাকেই কাটতে থাকে।
আচমকা এমন একটা আক্রমণে ট্রয়ের সৈন্যরাও দিশেহারা হয়ে যায়। অগত্যা যুদ্ধে নামতে হয় প্যারিসকে। কিন্তু স্পার্টার গুপ্ত হিংস্র বাহিনীর কাছে বেকায়দায় পড়েন প্যারিস। যুদ্ধে মারা যান প্যারিস, তার ভাই হেক্টর, অ্যকিলিস, অ্যাজাক্স। যদিও এই ভয়ঙ্কর যুদ্ধের হত্যালীলা থেকে রেহাই দেওয়া হয়েছিল শিশু ও মহিলাদের। সেই সব অন্তঃপুরের মহিলাদের বন্দি করে দাসী বানানো হয়। ধবংস হয়ে যায়, ট্রয় নগরী।
আরও পড়ুন- নাগাল্যান্ডের ছাইচাপা রক্তক্ষয়ী এক ইতিহাস
ট্রয় নগরীর এই যুদ্ধের ইতিহাসকে একাংশ গবেষক নিছক কাল্পনিক গল্প বলেই মনে করেন, অন্য অংশ আবার মনে করে ট্রয়ের যুদ্ধ হয়েছিল ১৩০০ থেকে ১২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। ১৮৬৮ সালে হেনরিখ স্লিম্যান ও ফ্র্যাঙ্ক ক্যালভার্ট নামে দুই পুরাতত্ত্ব গবেষক, তুরস্কের হিসার্লিক অঞ্চলে এক প্রাচীন নগরীর খোঁজ পান। সেখান থেকে যা উপকরণ মিলেছে, তা মহাকাব্যের দেওয়া বর্ণনায় ট্রয় নগরীর সঙ্গে অনেকাংশ মিলে যায়। পরে আরও কিছু তথ্য প্রমাণ হাতে আসে গবেষকদের। এরপরেই তাঁরা বিশ্বাস করতে থাকেন, মহাকাব্যে যে ট্রয় নগরীর কথা উল্লেখ রয়েছে, তার অস্তিত্ব বর্তমান সময়ে মিলেছে।