ফিচার
Trending

বিষ্ণুপুর, অতীতের অন্তরালে মল্লভূম

History of Bishnupur

The Truth Of Bengal : কথায় বলে ইতিহাস তার নিজস্ব ছন্দে চলে। ইতিহাসের পুনর্জন্ম হয়। ইতিহাস বেঁচে থাকে বহমান শিল্প সংস্কৃতি হাত ধরে। এই বাংলার বুকে এমনই একাধিক শিল্প, সংস্কৃতি, ঐতিহ্যের জন্ম হয়েছিল, একটি অভূতপূর্ব সাম্রাজ্যের হাত ধরে। কিন্তু সেই ইতিহাস আজ ম্লান। বাংলার বিষ্ণুপুর সাম্রাজ্যের যে গৌরবজ্জ্বল পারম্পরিক ইতিহাস জন্ম নিয়েছে, তার কাহিনি গাথা আজ অনেকটাই ধুসর। যদিও তার অনন্য শিল্প নিশান বেঁচে রয়েছে, স্বতন্ত্র সংস্কৃতির হাত ধরে। কিন্তু এই সাম্রাজ্যের বিয়োগান্ত অন্তর্জলি যাত্রার কাহিনি হয়তো অনেকেরই অজানা। কীভাবে উত্থান হয়েছিল বিষ্ণুপুর সাম্রাজ্যের? কীভাবেই বা উধাও হয়ে গেল, একটা গোটা সাম্রাজ্যের নাম ও নিশান? আজকের পর্বে থাকছে, সেই অতীতকে খুঁজে দেখা।

বিষ্ণুপুরের অতীত খুঁজতে গেলে, ইতিহাসের অনেকটাই গভীরে যেতে হবে। তারও আগে জানতে হবে, বাঁকুড়ার, বিষ্ণুপুরের লৌকিক সংস্কৃতির অন্দরমহল, ইতিহাসের মোড়কে থাকা কিংবদন্তীর শাখা প্রশাখাকে। একটা সময় এই অঞ্চলকে বলা হত রাঢ়দেশ। প্রচীন মহাভারত সময়কালকে ধরলে, এই বিষ্ণুপুরই ছিল সুহ্মইরাঢ়া। প্রাচীন জৈনসূত্রে রাঢ়দেশের বর্ণনা রয়েছে। আচারঙ্গসূত্রে লাঢ় বা রাঢ়দেশকে বলা হয়, জনপথহীন বনভূমি। তাই বিষ্ণুপুরকেও বন বিষ্ণুপুর এখনও বলা হয়ে থাকে। যার অস্তিত্ব এখনও রয়েছে। রাঢ়দেশের প্রাচীন ইতিহাস ঘাঁটলে জানা যায়, জৈন মহাবীর রাঢ়দেশে যখন ভ্রমণ করেছিলেন, তখন বর্বর অধিবাসীরা তাঁর পিছনে কুকুর লেলিয়ে দিয়েছিল।  অর্থাৎ সেই সময় পর্যন্ত এই অঞ্চলে কোনও বড় রাজা রাজত্ব করেননি। স্থানীয় জনগোষ্ঠীর অধীনেই ছিল এই বিস্তীর্ণ অঞ্চল।  বাঁকুড়া, বিষ্ণুপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চল বনভূমি হওয়ার কারণে, এখানকার ভূপতিরা, সেভাবে অন্য কোনও রাজার পরাধীন ছিল না। আর এখানেই আসে বড় প্রশ্ন, তাহলে কি প্রথম থেকে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে থেকেই উঠে এসেছিলেন কোনও রাজা বা প্রধান। অধিকাংশ ইতিহাসবিদদের মত, বিষ্ণুপুরের মল্লরাজ বংশের সূচনা হয়েছিল, স্থানীয় কোনও জনগোষ্ঠীর হাত ধরেই। পরবর্তী কালে রাজত্বকে গৌরবান্বিত করতে তাঁরা কুলীন হয়েছেন।

 

আদিমল্লের গড়ে

বিষ্ণুপুরের মল্ল রাজবংশের আদি ইতিহাস অনেকটাই রহস্যাবৃত। ঠিক কোন রাজার হাত ধরে মল্লরাজবংশের প্রতিষ্ঠা হয়েছে, তারা কোথা থেকে এসেছিলেন, তা নিয়ে রয়েছে নানা জনশ্রুতি, কিংবদন্তী। আর সেই জনশ্রুতিকে আধার করলে জানা যায়, আদিমল্লের হাত ধরেই তৈরি হয় মল্লরাজবংশের প্রতিষ্ঠা।  সময়টা ৬৯৫ খ্রিস্টাব্দ।

মল্লরাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন আদিমল্ল। এই রাজবংশের প্রতিষ্ঠা নিয়ে একটি চালু কিংবদন্তী রয়েছে। সেটি হল,৬৯৫ খ্রিস্টাব্দে এক রাজপুত্র পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে তীর্থে যাচ্ছিলেন। তিনি কোতলপুর থেকে কিছু দূরে লাউগ্রামের গভীর অরণ্যে তাঁবু ফেলেন। সেখানেই তিনি তাঁর সন্তানসম্ভবা স্ত্রী অসুস্থ হয়ে পড়েন। অগত্যা তাঁকে এক স্থানীয় ব্রাহ্মণ পরিবারের তত্ত্বাবধানে রেখে তীর্থে যান। রাজার স্ত্রী এক পুত্র সন্তানের জন্ম দেন। কিন্তু রানি মারা যান। পরে রাজার গ্রামে ফিরে দেখেন, তাঁর স্ত্রী মারা গিয়েছে কিন্তু এক পুত্র সন্তান রেখে গিয়েছেন। রাজা ওই সন্তানকে নিঃসন্তান ব্রাহ্মণ দম্পতির হাতে সঁপে দেশে ফিরে যান। সাত বছর বয়সে ছেলেটি রাখালের কাজ শুরু করে। অত্যন্ত অল্প বয়সে বালকটি গ্রামের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তাঁকে মল্লপ্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। মাত্র ১৫ বছর বয়সে সেই বালক অপ্রতিদ্বন্দ্বী মল্লযোদ্ধা হয়ে ওঠে। তারপরেই তার নাম হয়ে ওঠে আদি মল্ল। তিনি আশে পাশের কয়েকটি গ্রামের প্রধান হয়ে ওঠেন। সেই থেকে মল্ল রাজবংশের সূচনা হয়। পরবর্তী সময়ে জয় মল্ল, বেণুমল্ল, কিনুমল্লসহ একাধিক রাজা রাজারা ধীরে ধীরে সাম্রাজ্যের বিস্তার করেন। মল্ল রাজবংশের ৪৯তম রাজা ছিলেন বীর হাম্বির। তিনি সিংহাসনে বসেন ১৫৮৬ সালে। তিনি ছিলেন মুঘল সম্রাট আকবরের সমসাময়িক। তিনি বাংলার সুবেদারের কাছে রাজস্ব প্রদান করতেন। এবং মুঘল সাম্রাজ্যের সার্বভৌমত্ব স্বীকার করে নেন। তিনিই প্রথম শ্রীনিবাস আচার্যের কাছে বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত হন। কিন্তু একজন রাজা আচমকা বৈষ্ণব ধর্মে কেন দীক্ষিত হতে গেলেন? তা নিয়েও রয়েছে এক কিংবদন্তী। নরোত্তম দাসের প্রেমবিলাস ও নরহরি চক্রবর্তী রচিত ভক্তিরত্নাকর থেকে জানা যায়, শ্রীনিবাস ও তার ভক্তরা বৃন্দাবন থেকে গৌড়ের উদ্দেশে রওনা দেন। যাত্রাপথে হাম্বিরের সেনা তাদের লুঠ করে। শ্রীনিবাস রাজদরবারে বিচারের জন্য এলে, রাজা লুঠ হওয়া সম্পত্তি উদ্ধার করে দেখেন, সেখানে গীতা ও পুঁথি রয়েছে। শ্রীনিবাসকে সেই পুঁথি পাঠ করতে বলেন। তাঁর গীতা পাঠ শোনার পরেই রাজা বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষা নেন এবং শ্রীনিবাসকে প্রচুর অর্থ ও ভূমিদান করেন।

মন্দিরনগরী বিষ্ণুপুর

মুঘল আমল থেকে মল্লরাজাদের সুসম্পর্ক ছিল। তাই একটা দীর্ঘসময় ধরে বড় কোনও সমস্যার মধ্যে কখনও পড়তে হয়নি বিষ্ণুপুরের রাজাদের। বরং শিল্প, সংস্কৃতির ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র ঐতিহ্য বিকাশ একের পর এক মাইলফলক তৈরি করতে পেরেছিল। তার নজির এখনও ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বিষ্ণুপুর শহরজুড়ে।

মন্দিরনগরী বিষ্ণুপুর। ১৬০০ খ্রিস্টাব্দে মল্লরাজা বীর হাম্বিরের হাত ধরে সূচনা হয়, প্রথম মন্দিরের সূচনা। রাসমঞ্চ। এই মন্দিরের ব্যবহার হত, রাসউৎসবের সময়। পিরামিড আকৃতির অদ্ভুত স্থাপত্যের অনন্য উদাহরণ। পরবর্তী সময়ে জোড়বাংলো, পঞ্চরত্ন মন্দির, মদনমোহন মন্দির, লালজি মন্দির, রাধাশ্যাম মন্দির, নম্দলাল মন্দির, কালাচাঁদ মন্দির, রাধাবিনোদ মন্দির, মদনগোপাল মন্দির, রাধাগোবিন্দ মন্দির, জোড়মন্দিরসহ একাধিক মন্দির নির্মাণ করা হয়। সবচেয়ে মজার বিষয় হল, একটি মন্দিরের স্থাপত্যের সঙ্গে অন্য মন্দিরের কোনও মিল নেই। আর এই অনন্য স্থাপত্যের জন্যই, স্বতন্ত্র বাঙালি বাস্তুকলার জন্ম হয়েছে। যা বিশ্বব্যাপী বাস্তুকলা বিদ্যার্থীদের কাছে সমাদৃত। এতো গেল মন্দিরনগরীর কথা। সঙ্গীত শিল্পের ক্ষেত্রেও পূর্ব ভারতে অনন্য স্বাক্ষর বহন করে চলছে, শাস্ত্রীয় সঙ্গী বিষ্ণুপুর ঘরাণা। যা অবিভক্ত বাংলার একমাত্র ধ্রুপদী সঙ্গীত ঘরানা। ইতিহাস থেকে জানা যায়, বিষ্ণুপুরের সঙ্গীত ঘরানার সূচনা হয়েছিল ১৩ শতাব্দী থেকে। যদিও এর কোনও প্রমাণ্য তথ্য মেলে না। তবে উত্তরভারতের প্রতিষ্ঠিত ধ্রুপদশিল্পীদের যে নিয়ে আসা হত, তার কিছু প্রমাণ মেলে। কিংবদন্তী রয়েছে ১৭ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ, মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেবের আমলে কট্টর ইসলামপন্থা শুরু হয়। সেই সময়, সেই সময়, লখনউ, আগ্রা থেকে বহু খেয়াল সঙ্গীতশিল্পী বাংলায় চলে আসেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন তানসেনের বংশধর বাহাদুর খান। তাঁরই শিষ্য ছিলেন পণ্ডিত রামশঙ্কর ভট্টাচার্য, তাঁর হাত ধরেই বিষ্ণুপুর ঘরানার প্রতিষ্ঠা হয়। অষ্টাদশ শতাব্দীর পর থেকে বিষ্ণুপুর সঙ্গীত ঘরানা এক উচ্চ শিখরে পৌঁছয়। বিষ্ণুপুর সঙ্গীত শুধু নয়, দ্যুত ক্রীড়ার ক্ষেত্রে এক অনন্য নজির এখনও রয়েছে এ শহরে। আজ সারা বিশ্ব জানে তাস খেলার কথা। কিন্তু এই বাংলার বুকেই কয়েক শতাব্দী আগে জন্ম নিয়েছিল, বাংলার নিজস্ব তাস খেলার ঘরানা। যা দশাবতার তাস নামে পরিচিত। আজ এই খেলা লুপ্তপ্রায়। কিন্তু কিছু শিল্পীর হাত ধরে বেঁচে রয়েছে, দশাবতার তাস। যা এক সময় রাজদরবারে খেলা হত সারা রাত ধরে।

অদ্ভুত আঁধারে বিষ্ণুপুর

বিষ্ণুপুরের রাজকাহিনীর উত্থানের ইতিহাস অনেকটাই রূপকথা মতো হলে, সাম্রাজ্যের আদিত্য যতই পশ্চিমদিকে হেলেছে, ততই বিয়োগান্ত কাহিনীর জন্ম দিয়েছে। সূর্য অস্ত গেলে, যেভাবে গোধুলি পেরিয়ে অন্ধকার নেমে আসে, ঠিক তেমনটাই হয়েছে, বিষ্ণুপুর রাজকাহিনির ইতিহাসে। মুঘল আমলেও স্বর্ণোজ্জ্বল অতীতকে ধরে রাখতে পারলেও, ইংরেজ আমলে এই রাজ পরিবারকে, কাঙাল হতে হয়েছে।

ভারতের ইতিহাস ঘাঁটলে, বহু সাম্রাজ্যের ইতিহাস মেলে। যুদ্ধ, রণনীতি, রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের বর্ণনাতেই জানা যায়, কীভাবে দাপুটে, রাজা, মহারাজাদের সাম্রাজ্য বিস্তার হয়েছিল। সেদিক থেকে বিচার করলে, বিষ্ণুপুরের ইতিহাসে তেমন কোনও রক্তক্ষয়ী বড় সংগ্রামের কথা লেখা নেই। বরং শান্তিপ্রিয়, প্রজাহিতৈষী, পড়শি রাজ্যের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায়ই ছিল প্রধান লক্ষ্য। ইতিহাস থেকে জানা যায়, এই I রাজবংশের এক রাজা ছিলেন ধরি মল্ল। তিনি এতোটাই চতুর ছিলেন, যে মুঘল দরবারে যে পরিমাণ রাজস্ব তিনি দিতেন, তার পুরোটাই নানা ছলে, কৌশলে নিজের রাজ্যে ফিরিয়ে আনতেন। অর্থাৎ সুসম্পর্ক এমন একটা জায়গায় নিয়ে গিয়েছিলেন, যেখানে মুঘল সম্রাটরাও আপত্তি করতেন না। কিন্তু একটা সময় এলো, বিষ্ণুপুরে কালো ছায়া নেমে এলো। বাংলায় দফায় দফায় শুরু হল, মারাঠা বর্গি হানা। আর তার ঝড় সহ্য করতে হয়েছে বিষ্ণুপুরকে। তারপর ইংরেজদের চাপানো অতিরিক্ত কর, দুর্ভিক্ষ, ইংরেজদের কুটিল রাজনীতির জেরে এক রাজার সঙ্গে অন্য রাজা, নবাবের বিবাদ, সব মিলিয়ে দ্রুত পতন হতে থাকে বিষ্ণুপুর রাজবংশের। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ ও উনবিংশ শতাব্দীর  গোড়া থেকে বিষ্ণুপুরের রাজদের চরম দুরাবস্থা দেখা দেয়। ১৮০৬ সালে রাজা চৈতন্য সিংহের আমলে গৃহবিবাদের জেরে রাজত্ব সংকটের মুখে পড়ে, ইতিহাস থেকে জানা যায়, রাজা চৈতন্যসিং, গৃহবিবাদে এতোটাই অতিষ্ট হয়ে ওঠেন যে তিনি জীবীতকালেই তাঁর পুত্রদের জন্য  স্বতন্ত্র ব্যবস্থা করে যান। তাঁর দ্বিতীয় পুত্রকে কুচিয়াকোল পরগনা, তৃতীয়পুত্রকে ক্ষেত্রমোহনকে নাটকাঞ্চনপুর এবং চতুর্থপুত্র দ্বিতীয় ক্ষেত্রমোহনকে ইন্দাসের জমিদারি দেন। ১৮০১ সালে মহারাজা মাধবদেব সিংহের আমলে, রাজ্য আরও সংকটের মুখে পড়ে। ইংরেজদের কর দিতে না পারায়, নিলামে ওঠে, রাজত্ব। আর সেই জমিদারিত্ব কিনে নেন বর্ধমানের রাজা। পরিস্থিতি এতোটাই সঙ্গীন হয়ে ওঠে, কয়েক শতাব্দী ধরে থাকা বিষ্ণুপুর রাজবংশের কুলদেবতা মদনমোহনকেও বন্দক রাখতে হয়, কলকাতার এক ব্যবসায়ীর কাছে, অর্থের বিনিময়ে। পরবর্তী কালে অবশ্য, মদনমোহন আর ফিরে যাননি বিষ্ণুপুরে। স্থায়ী হয়েছেন, কলকাতার ব্যবসায়ীর বাড়িতেই।

 

FREE ACCESS

Related Articles