ফিচার

চেতলা থেকে চাঁদের হাট (ফিরহাদ হাকিম)

From Chetla to Chander Hat (Firhad Hakim)

Truth Of Bengal: সৌরভ গুহ: -আর বলো না, এই পোলিটিক্স করতে এসেই রাত জাগা শুরু হয়ে গেল। তা রাত জেগে কী পলিটিক্স করতেন?

-রাত জেগেই তো মরা পোড়াতে যেতাম, মরা পোড়ানোর দল ছিল তো আমার।

-যা বাব্বা, যুব কংগ্রেস দল করতে এসে মরা পোড়ানোর দল? আরে ওটাই তো স্ট্যাটেজি। তিনটে কাজ একসঙ্গেই হত।

-মরা পুড়িয়ে তিনটে কাজ হয়ে গেল?

ওটাই তো না, স্যারের, প্রথম কাজ; সমাজসেবা-দ্বিতীয় কাজ, ছেলেদের একটা টিম রেডি হয়ে গেল, আর, তৃতীয় একটা উদ্দেশ্য ছিল বটে। এ যাবৎ বলে একটু ব্রেক কষলেন মন্ত্রীমশাই। চোখে, ঠোঁটে মুখে এক রহস্য চাপা হাসির ঝিলিক।

তৃতীয়, কারণটায়, একটু মজা আছে। বলেই আবার এদিক ওদিক দেখেনিলেন, সরকারি অফিস বলে কথা! আমলা- আধিকারিকরা ঘরে ঢুকছেন বেরোচ্ছেন। তাড়াতাড়া ফাইলে খানিকটা যান্ত্রিকভাবেই সই পর্ব চলছে তো চলছেই। তারই মাঝে খোলস খুলে একটু একটু করে বেরোতে চাইছে অন্য মানুষ।

আসলে মিষ্টি খেতে এতো ভালোবাসতাম, কিন্তু তত পয়সা ছিল না তো।

-তার সাথে মরা পোড়ানোর কি সম্পর্ক?

-আরে পাগলা, ওটাই তো আসল সম্পর্ক। মরা পোড়ালেই তো মিষ্টি

খাওয়াবে। পোড়ানোর দিন খাওয়াবে আর শ্মশানযাত্রী হিসেবে শ্রাদ্ধে আবার খাওয়াবে।

-ইন্টারেস্টিং!

-শুধু ইন্টারেস্টিং। হাইলি ইন্টারেস্টিং। পুড়িয়ে মিষ্টি একপ্রস্থ খেয়ে চলে এলাম। এবার শ্রাদ্ধের দিন সন্ধ্যেবেলা থেকে হবে অনুষ্ঠান। বাড়িতে হাজির হয়ে গেলাম দলবল নিয়ে। তা তখন তো এখনকার মতো ক্যাটারিং ছিল না। পাড়ার ছেলেরাই সব করত। ব্যাস সন্ধে থেকে লেগে গেলাম। খাবার পরিবেশন, তদারকি আর তার মাঝেই পটাপট মিষ্টি মুখে পুরছি। ভাত দিচ্ছি, ডাল দিচ্ছি, আর পাত্র রাখতে গিয়ে ভাঁড়ার ঘরে টপাটপ মুখে পুরছি, রসগোল্লা, পান্তুয়া, সন্দেশ।” ফিনকি দিয়ে পড়ছে হাসির ঝলক। আমলা দপ্তর ক্যাবিনেট, মন্ত্রীত্ব কোথায় কি, চেয়ারে এক পা তুলেই ফিরহাদ হাকিম তখন ডুব মেরেছেন স্মৃতির সমুদ্রে।

শ্মশান পাড়ের চেতলা তখন নিভু নিভু এক ছায়াঘেরা জনপদ। নিম্নবিত্ত বস্তি অঞ্চলের হাজার হাজার মানুষের মাঝখানে কয়েক চিলতে মধ্যবিত্ত পাড়া। মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে খানকতক বনেদী বাড়ি। গঙ্গার স্রোত যত তলানিতে এসে ঠেকেছে এক সময়ের কালীঘাট মন্দির ঘেঁষা অভিজাত চেতলা; এলাকাও জৌলুস হারিয়েছে একটু একটু করে। ফিরহাদ হাকিম যখন বড়ো হয়ে উঠছেন। তখন চেতলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল পরিচিত ছিল, কলকাতার তৎকালীন ডেপুটি মেয়র মণি সান্যালের নামে। সিপিআই-এর এই দাপুটে নেতা শ্মশান সংলগ্ন পশ্চিম পাড়ে তাঁর দাপট বজায় রাখলেও ওপারে শ্মশান চত্বর ঘিরে গজিয়ে উঠছে স্বপন, শ্রীধরদের মতো এলাকার দাদাদের দলবল। গঙ্গার একপাড় ঘেঁষে দাদাদের কার্যকলাপ মাঝে মধ্যেই আছড়ে পড়ে এপাড়েও। ফিরহাদ হাকিমদের তখন মুগুর ভাজা যৌবন। পাড়ায় প্রবল জনপ্রিয় ববির চেলা-চামুণ্ডাও নেহাৎ কম নয়। মমতা ব্যানার্জী নন, চেতলার ব্লক যুব কংগ্রেসের ওই তরুণ নেতা তখন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি সৌমেন মিত্রের অনুগামী। দলবল ধরে রাখতে গেলে একটু চা জলখাবার কিংবা বছর শেষের পিকনিক-সে সব খরচ তো একটু আধটু আছেই বইকি! কংগ্রেসের যুব নেতা বলে কথা, তা হোক না সে এলাকার। বকাবকির পাশেই একটু আবদার না রাখলে সে কিসের নেতা।

এদিকে এত কিছুর রেস্তো জোগাবে কে? সুতরাং একঢিলে তিন পাখি মারার অভিনব প্ল্যান। কেউ মারা গেল পাড়ায়, চিন্তা নেই ববির দলবল তো আছেই। ডাকলেই হাজির হয়ে যাবে। খুব গরীব হলে টাকার পয়সা দিয়েও বিলক্ষণ সাহায্য করে দেবে ও। আর সাধারণ মধ্যবিত্তের শ্মশানযাত্রী মানে, কাজ শেষে সৌজন্যের রসগোল্লা তো আছেই। তাতেই খুশি। আর কি চাই ওদের। চেতলার ফিরহাদ হাকিমের বাড়ির পাশেই থাকেন মোহনবাগান কোচ সঞ্জয় সেন। সচ্ছল সঞ্জয়দের পরিবারে সারাবছর অনুষ্ঠান লেগেই আছে। আর নিমন্ত্রিতদের পরিবেশনের ভার? চিন্তা কি? ওই তো ববি আসছে সঙ্গে ওর দলবল। এসেই একগাল হেসে বলবে, চিন্তা নেই মাসিমা, আমি সব সামলে নেব। ববি যে এসব ব্যাপারে চিন্তাহরণ, তা মাসিমাও বিলক্ষণ জানেন, তবে মাসিমার চিন্তা অন্য কিছু নিয়ে, আহারে ছেলেগুলো কত করে, ভাঁড়ার ঘরে ওদের জন্য একটু আলাদা করে মিষ্টি রাখিস, যেন কার্পণ্য না হয়। এই জন্যই মাসিমাকে এত পছন্দ ববির। এ বাড়িতে কিছু হলেই হল, ববির হাজির হতে চোখের পলক ফেলার অপেক্ষা মাত্র।

মিষ্টি প্রিয় ববির রাজনীতি জুড়ে সেই মিষ্টির ছড়াছড়ি। সময় অনুকূল থাক বা বিপক্ষে ববির মুখের মিষ্টি হাসি কাড়বে কার সাধ্যি। ব্যবহার খানাতেও বিলকুল মিষ্টিই ঝরে পড়ছে। তাই তো বিপক্ষের রাজনীতি করা মানুষও ববির সাথে মিশে যান। আর সে মেশা কি এমন তেমন মেশা। এ হল যাকে বলে আমে দুধে মেশা। নির্বাচনের উত্তাপেও তা ঝরে পড়ে না। চেতলার নির্বাচন। তৃণমূল কংগ্রেসের ক্যাম্পে হন্যে হয়ে বসে রয়েছে রিপোর্টারকূল। কয়েক চক্কর মেরেও কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না ফিরহাদ হাকিমকে। সম্ভাব্য সব জায়গায় খুঁজে মোটামুটি যখন হতাশা হওয়ার জোগাড়, ঠিক তখনই খবর এলো বামফ্রন্টের ক্যাম্পে বসে দিব্যি আড্ডায় মশগুল ফিরহাদ হাকিম। আর আড্ডার ফাঁকেই চলছে মিষ্টি মুখ।

মিষ্টি তো ফিরহাদ হাকিমের কাছে শুধু জিভের স্বাদ নয়। জীবনের আস্বাদও। মা, মন্ত্রী, তিনকন্যা, বোন, বোনঝি, জামাই সবাইকে মিলে সেই মিষ্টিরই তো ছোঁওয়া। যাক রূপক তো অনেক হল। এবার আসা যাক সত্যি মিষ্টি খাওয়ার গল্পে। ফিরহাদ হাকিমের জনপ্রিয়তায় আজকাল গোটা চেতলা ববিময়। বাড়ির মোড়ও তার নামেই আলোকিত। কিন্তু সবদিন তো এমন ছিল না। ববিদের বাড়ির মোড় আগাগোড়া পরিচিত মিষ্টির দোকান অমৃত কুম্ভের নামে। তো অমৃত কুম্ভের বাঁধা খদ্দের তখনও দেশের নেতা হয়ে ওঠেনি। ইদানিং দোকানের মালিক লক্ষ্য করছেন গরম রসগোল্লা কড়াই থেকে নামানোর এক মিনিট আগেই দোহারা চেহারার ববি দোকানের সামনে ঘুরঘুর করে। এ দোকানের মিষ্টি তৈরির টাইম টেবিল ওর মুখস্ত। রসগোল্লার পাশেই ফিরহাদ হাকিমের অবশ্যই পছন্দের, রসমালাই একবার খেতে শুরু করলে আর রক্ষে নেই।

‘দে তো আরেক খোরাই’ শেষ করেই, ‘আরেকটা দে’ সেটা শেষ হতেই ‘আজ হেবি হয়েছে, দে আরেকটা দে খাই।’ এই চলে প্রতিদিন। এক খোরাই দিয়ে শুরু করে খোরাই এর স্তুপ জমে, কিন্তু দোকান থেকে ফিরহাদ হাকিমের পা সরে না। দিনের পর দিন একই দৃশ্য দেখে ক্লান্ত দোকান মালিক একদিন কার্যত বেঁকেই বসলেন। ঘড়ির কাঁটা মিলিয়ে দোকানের সামনে হাজির হয়েছেন ফিরহাদ হাকিম। এসেই বাজখাই গলায় অর্ডার।

-‘কইরে দে এক খুরি রসমালাই।’

দোকানে অন্য দু-একজন খদ্দেরও ইতস্তত দাঁড়িয়ে। দোকানের মালিক অন্যদিন সঙ্গে সঙ্গে হুকুম তামিল করে, আজ কেমন যেন বিড়বিড় করছে।

ওদিকে মিষ্টির অ্যাডিকশন মাথায় চাপলে ববি হাকিমের বুদ্ধি লোপ পাওয়ায় জোগাড় হয়। বেশ অসন্তোষের সুরেই আবার বলে উঠলেন-

-‘আরে ব্যাপার কি দেনা।’

‘ভাবছি।’

দোকানি তখনও বিড়বিড় করছে।

-কিন্তু এখানে ভাবার কি আছে। ফিরহাদের মেজাজ তখন চড়ছে। এদিকে দোকানদার কি একটা ভেবেই চলেছে, তারপর হঠাৎ গোটা রসমালাই এর ট্রে টাই বের করে এনে হাতে ধরিয়ে দিল ববির। এমন ঘটনায় দোকানে উপস্থিত খদ্দেরকূল অবাক। হতভম্ব ফিরহাদ হাকিম নিজেও। ‘কি, কি হলো এসবের মানে কি?’ ফিরহাদের গলায় অপার বিস্ময়!

– মানে আর কি! সেই তো এক এক করে গোটা ট্রেই সাফ করবে মাঝখান থেকে কুড়ি পঁচিশটা খোরাই নষ্ট হবে, তার চেয়ে বরং ট্রে ধরে চোঁ করে মেরে দাও।

দোকানদারের কথা শুনে কেউ মুখ চেপে হাসছে, কেউ বা আবার বিস্ময়ে আড় চোখে দেখছে বিরাট চেহারার এই বিশেষ খদ্দেরটিকে। দেশের খাবার জুড়ে তখন এক কৌতুক পর্ব। কয়েক সেকেন্ড কি যেন ভাবলেন ফিরহাদ হাকিম, তারপর দোকানদারের হাত থেকে সত্যি সত্যিই রসমালাই ভরা ট্রে নিয়ে সোজা চোঁ করে মারলেন একটান। আজকের মোবাইল ক্যামেরার যুগ হলে নিশ্চয় চেতলা মোড়ের এই ছবি মুঠো ফোনে বন্দি হয়ে অন্তর্জালে ভাইরাল হয়ে যেত। তবে সে দৃশ্যের গুটি কয় স্বাক্ষী সেকথা আজও বিলক্ষণ মনে রেখেছেন। মন্ত্রী হয়ে, রাজ্য রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ মুখ হয়েও ফিরহাদ হাকিম নিজেও জীবনের এই সব মিষ্টি মোমেন্টস্ ভুলতে পারেন কই। ভুলতে পারেন না বলেই তো নিজের শিকড় তাঁকে সম্পৃক্ত করে রেখেছে তার এলাকার মনুষজনের সঙ্গে। আর সেই বন্ধনে রাজনীতি, নেহাতই গৌণ।

ববির রাজনীতির জীবনে আদর্শ মমতা ব্যানার্জী। আর ব্যক্তিগত জীবনের আইকন মুন্নাভাই এম.বি.বি.এস, সঞ্জয় দত্ত। কলকাতায় সঞ্জয় দত্ত-কে একথা অকপটে বলেও দিয়েছিলেন মন্ত্রীমশাই। ববির রাজনীতির মূল সুরট। যে ওই মুন্নাভাই এর মিষ্টি স্টাইলেই বাঁধা পড়ে আছে। ববির জীবনের পরতে পরতে যে শুধুই মিষ্টি। একবার তখন সদ্য বিয়ে হয়েছে, মামাতো বোনের বিয়েতে সস্ত্রীক বাসর জাগছেন ফিরহাদ হাকিম। ছোটো বোনের বাসর রাতে ঠাট্টা ইয়ার্কি চলছে। হঠাৎ-ই তার মধ্যে বোনের এক বান্ধবী বলে বসল, ‘শুনলাম তুমি নাকি প্রচুর মিষ্টি খেতে পারো।’

ফিরহাদ হাকিম একটু অপ্রস্তুত “না মানে মিষ্টি তো খাই”।

‘তা ৫০০টা মিষ্টি খেতে পারবে?’

-ভ্রু নাচিয়ে প্রস্তাব দিল বোনের বান্ধবী। একটু থেমে আবার বলল “যদি পারো ৫০০০ টাকা দেবো। আর না পারলে তুমি দেবে ৫০০০”।

-রাজী? ববি ও ঘাড় নেড়ে সম্মতি প্রকাশ করতেই বিয়ে বাড়ির ভাড়ার ঘর থেকে এল একের পর এক রসগোল্লার হাঁড়ি। ফিরহাদ হাকিমের মিষ্টি প্রীতি সম্পর্কে ধারণা ছিল না বোনের বান্ধবীদের কিন্তু যে দ্রুততায় একটা গোটা রসগোল্লার হাঁড়ি শেষ হয়ে গেল, তা দেখে কারোরই বিস্ময়ের সীমা থাকল না, এইভাবে চার চারটি হাঁড়ি মিলিয়ে ২০০টা রসগোল্লা যখন শেষ। তখন কার্যত ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা চালেঞ্জ যারা ছুঁড়ে দিয়েছিলেন তাদের।

আর লাগবে না, আর লাগবে না প্রায় হাত জোড় করে বলে উঠল বোনের বান্ধবীরা। এই নাও তোমাকে আমরা দিচ্ছি পাঁচ হাজার টাকা।

ববির মনে তখন যুদ্ধ জয়ের আনন্দ। স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে একটু চোখ টিপলেন। ভাবটা এমন, দেখলে কেমন দিলাম। ববি যে এই রকমই, হাসি, আড্ডায় জমজমাট।

চেতলার মহামিলন ঠেকের কথাই না হয় ধরা যাক। শত ব্যস্ততার মধ্যেও ওই ঠেকে ববির যাওয়া চাই-ই চাই। কংগ্রেসি সমর্থকদের একটি ঠেক, তৃণমূলীদের আরেকটি, বামপন্থীদের আবার অন্য কোথাও। রাজনীতির পথ ভিন্ন বলে কি আড্ডার সুর ছিন্ন হবে? তাই হয় নাকি? আড্ডা আর সঙ্গে চা, রাজনীতি তফাত যা- এই স্লোগান সামনে রেখেই চেতলার মহামিলন ঠেকের শুরু। সে ঠেকে সব রাজনৈতিক দলের লোকেরাই স্বাগত কিন্তু একটা শর্ত আছে, রাজনীতির প্রসঙ্গ পাড়লেই দিতে হবে জরিমানা। না, এ নেহাত কথার কথা না, নিয়মের হেরফের হলে জরিমানার হাত থেকে রেহাই নেই কারোরই। ববিই সেই ঠেকের প্রতিষ্ঠাতা। জরিমানার নিয়মখানাও তারই। রাজনীতির প্রসঙ্গ তুললেই জরিমানা পঞ্চাশ টাকা। ইদানিং পারত পক্ষে মিষ্টির থেকে দুরেই থাকতে হয়। মিষ্টির স্বাদ কিআর নোনতায় মেটে। তবু আজকাল নোনতা গিলতে হয় বই কি! চায়ের সঙ্গে চানাচুর কিংবা রাজনীতির রকমফের, জীবনচর্চায় ইদানিং বেশ মিশেছে নোনতার আস্বাদ। চেতলা পেরিয়ে, অধুনা আলিপুর বিধানসভা কেন্দ্র। উপনির্বাচনে রাজ্য বিধানসভায় প্রবেশ থেকে পোর্ট বিধানসভা কেন্দ্র, পর পর দুবারের বিধায়ক, জীবন যত এগিয়েছে, নদী যত সমুদ্রের দিকে পা বাড়িয়েছে, চেতলা ঘাটের মিঠাজলে ক্রমে মিশেছে লবণাক্ত স্রোত।

ছাদে বোমা ফেটে পুরপিতা রঞ্জিত শীলের ছেলের অপমৃত্যু, হরিমোহন ঘোষ কলেজে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে দুষ্কৃতী তাণ্ডবে পুলিশ কনস্টেবল তাপস দাসের মুত্যু কিংবা নারদা স্টিং অপারেশন, জীবন যত এগিয়েছে নানান বির্তকের লবণ আছড়ে পড়েছে ফিরহাদ-এর জীবনে। বেড়েছে বাড়তি সতর্কতাও, একবার রাইটার্স থেকে বেরিয়ে গাড়িতে ওঠার মুখে মেজাজ হারালেন ববিদা। নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা দেহরক্ষীর দিকে কঠিন চোখে তাকিয়ে বললেন, “কেউ আক্রমণ করলে তুমি আমাকে বাঁচাবে, একথা আমি কোনও দিন বিশ্বাস করি না, তবু তোমাকে পাশে থাকতে বলি কেন জানো? যাতে কেউ আক্রমণ করলে, তোমার কোমরের খাপ থেকে রিভলবারটা তুলে নিজেই চালিয়ে দিতে পারি।” মন্ত্রীমশাই-এর মুখে বেমানান এই বাক্যবন্ধে কিছুটা হলেও হকচকিয়ে মাথা নিচু করে রইলেন দেহরক্ষী। গাড়িতে উঠে শুনতে পেলেন, ফোনের ওপ্রান্তে মন্ত্রীমশাই কাকে যেন বলছেন- ওসব মাফিয়া টাফিয়া আমি জানি না, কান খুলে শুনে রাখো, আমি থাকতে এসব চলতে দেব না, পোর্টের সবচেয়ে বড়ো গুণ্ডা আমিই। বেমানান হলেও ফোন কানে এমন কথোপকথন আজকাল শোনা যায় তার মুখে। ফোন রেখে দীর্ঘশ্বাস ছাড়তে ছাড়তে আরেকটা কথাও শোনা যায়-“ধুর সব থেকে জীবনে ভালো সময় কখন কাটিয়েছি জানো, যখন চেতলার কাউন্সিলর ছিলাম।”

পুর অধিবেশনে বন্ধুদের সঙ্গে মিলে শোরগোল, এসব স্মৃতিই কুঁরে কুঁরে খেতো ফিরহাদ হাকিমকে। তাঁর কলকাতা পুরসভা দুর্বলতার কথা জানেন তার পাড়া থেকে পরিবার সবাই। তাই রাজ্য ক্যাবিনেটের গুরুত্বপূর্ণ মুখ হয়েও সেদিন যখন তাঁকে মেয়র নির্বাচিত করল দল, গোটা চেতলা ব্যাণ্ড বাজিয়ে হর্ষ ধ্বনিতে মাতোয়ারা হয়ে বললো যাক্ বাবা ঘরের ছেলে ঘরে ফিরলো।” চেতলা যে তার জীবনের অবসেশন, আরোগ্য। আর চেতলা মানেই ছোটোবেলার মিষ্টি স্মৃতি, অলিগলির মিষ্টির দোকান। যার একটির গায়ে ভোট আসলেই জ্বল জ্বল করে পোষ্টার। বড় বড় হরফে লেখা থাকে স্লোগান-

“আমাদের ববি, কাজ করাই ওর হবি।”

রসমালাই হোক আর পান্তোয়া, প্রথম নির্বাচনে জেতার আস্বাদ হোক বা হৈ হুল্লোড়, মিষ্টান্ন হোক বা মিষ্টি মোমেন্টস্, ফিরহাদ হাকিমের কাছে চেতলা যেন এক আস্ত মিষ্টির কারখানা।

Related Articles