ফিচার

এই জমিদার বাড়ির দুর্গাপুজোয় এসেছিলেন লর্ড ক্লাইভ, দিয়েছিলেন হাজার টাকার প্রণামী

ক্লাইভ সঙ্গে এনেছিলেন ১০ হাজার টাকার সন্দেশ

The Truth of Bengal: ব্রিটিশ শাসনকালে বাংলায় যতগুলি জমিদার বাড়িতে দুর্গোৎসব শুরু হয়েছিল, তার মধ্যে অন্যতম আন্দুলের রাজবাড়ি। হাওড়াজেলাতো বটেই, বাংলার অন্যতম জমজমাট দুর্গাপুজো হত আন্দুলেই। কিংবদন্তী রয়েছে, পলাশীর যুদ্ধের পর লর্ড ক্লাইভ এই আন্দুল রাজবাড়িতে এসেছিলেন যখন প্রথম সূচনা হয়েছিল এই বাড়ির দুর্গাপুজোর। সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন জুড়ি গাড়ি করে একাধিক ডালা সন্দেশ এবং দিয়েছিলেন  হাজার টাকা প্রণামী।

আন্দুল-রাজ রামলোচন রায় সেবারই দুর্গাপুজোর প্রচলন করেন। ক্লাইভের দেওয়ান, পণ্ডিত মানুষ ছিলেন রামলোচন। জমিদারির জন্য পেয়েছিলেন আটটি মৌজা। ক্লাইভের সুপারিশে শেষ মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের কাছ থেকে পেয়েছেন ‘রাজা’ উপাধিও। সেই ক্লাইভের পরামর্শেই আন্দুল রাজবাড়িতে শুরু হয়েছিল দুর্গাপুজোর সূচনা। তাঁর অনুগত ‘রাজা’কে উৎসাহ দিতে প্রথমবার পুজোতে উপস্থিত হয়েছিলেন লর্ড ক্লাইভ। সঙ্গে এনেছিলেন ১০ হাজার টাকার সন্দেশ, দিয়েছিলেন এক হাজার টাকার প্রণামী। দেবীর পাদপদ্মে নিবেদনের জন্য ১০৮টি পদ্ম।

সেদিন রাজবাড়ির ইতিহাসে জন্ম নিয়েছিল নতুন এক ঐতিহ্যের, ইতিহাসের।  কামান গর্জন, তূর্যধ্বনি, আলোর রোশনাই, কাঙালি ভোজন, নাচমহলের বেলোয়ারি ঝাড়ের টুংটাং শব্দের সঙ্গে বাইজিদের মুজরো-  রাজবাড়ির শারদ-বন্দনায় একটি মহিষ, ১২টি ছাগ উৎসর্গ করা হয়েছিল। বর্তমানে সেই জৌলুস হারিয়ে গিয়েছে, যদিও রীতি ও পুজোর বিধিতে খামতি নেই। পরিবারের বর্তমান সদস্যদের দাবি, সরকারি নিষেধাজ্ঞায় কামান গর্জন ও বলি বন্ধ হয়েছে ঠিকই, কিন্তু পুজোর পদ্ধতি আগের মতোই মেনে চলা হয়। কৃষ্ণা-নবমী তিথিতে শুরু হয় কল্পারম্ভ।

প্রাচীন রীতি মেনে ১২দিন আগেই বসে রাজবাড়ির পুজোর আসর। দুর্গোৎসবকে উপলক্ষ করে রাজবাড়ির মাঠে বসে মেলা। প্রথা মেনে এখনও রাজবাড়ির সদস্যরা শামিল হন ধুনুচি নাচে। অষ্টমীর দিন রাতে এই ধুনুচি নাচে এক অনন্য আবহ তৈরি করে। মন্দিরের আদলে এসেছে আধুনিকতার স্পর্শ। বেলোয়ারি ঝাড় নেই, লাগানো হয়েছে আধুনিক মানের ঝাড়বাতি। এখনও রীতি মেনেই আটমণ মাটি দিয়ে তৈরি হয় একচালার প্রতিমা। এখানে দুর্গার বাহন সিংহের মুখ, অনেকটাই ঘোড়ার আদলে, যা অন্যান্য জমিদার বাড়িতে দেখতে পাওয়া যায়।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, শুরুটা হয়েছিল ১৭৭০ সালে। পলাশি যুদ্ধ পেরিয়ে গেছে বেশ কিছু বছর আগে। নবাবরা থাকলেও, সেই ক্ষমতা আর নেই। বরং রাজদণ্ড হাতে উঠে এসেছে ব্রিটিশরা। প্রথমে ক্লাইভ, পরে ওয়ারেন হেস্টিংসের হাত ধরে বাংলা তথা গোটা ভারতে প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে ইংরেজ বাহিনী। এসবের ভেতরেই জন্ম আন্দুল রাজপরিবারের দুর্গাপূজার। রাজবাড়িটি ১৮৩৪-এ শুরু হলেও, ইতিহাসের শুরু আরও আগে। তখন এই বংশের কর্তা ছিলেন রামলোচন রায়। পেশায় ছিলেন লর্ড ক্লাইভের দেওয়ান। পরবর্তীতে হেস্টিংসের আমলেও একই কাজে নিযুক্ত হয়েছিলেন। নিজের কাজ এবং বুদ্ধির জেরেই ইংরেজ শাসকদের ঘনিষ্ঠ এবং বিশ্বাসভাজন হয়েছিলেন রামলোচন। তার ‘পুরস্কার’ও পেতেন হাতেনাতে। একটু একটু করে রায় পরিবারের কোষাগারে অর্থ ঢুকতে লাগল।

ক্লাইভ বাংলার মসনদে বসার পর বাংলার রাজনৈতিক চেহারাটা বদলাতে থেকে। এদিকে বিপুল অর্থের মালিক হন রামলোচন রায়। আর নিজের ‘বন্ধুদের’ খালি হাতে ফেরাতেন না ক্লাইভও। যথাসময় ‘রাজা’ উপাধি পেলেন রামলোচন। শুরু হল আন্দুল রাজপরিবারের যাত্রা। এই সময়ই কলকাতায় নবকৃষ্ণ দেব শোভাবাজারের বাড়িতে শুরু করলেন দুর্গাপুজা। সেই পুজোতেও হাজির হয়েছিলেন স্বয়ং ক্লাইভ। এবার রাজা রামলোচন রায়ই বা বাদ যান কেন? এত বিশাল জায়গা তাঁর, এত বড়ো জমিদারি। জাঁকজমক করে করবেন মা দুর্গার আরাধনা। যেমন ভাবা তেমনি কাজ। বিপুল অর্থ খরচ করে ১৭৭০ সালে শুরু হল আন্দুল রাজবাড়ির দুর্গাপুজা।

সেই রাজাও নেই, রাজপাটও নেই। কিন্তু ইতিহাস আজও আঁকড়ে ধরে আছে হাওড়ার বিখ্যাত এই রাজবাড়িকে। আর রয়েছে দুর্গাপূজা। রাজত্ব গেলেও এখনও প্রথা মেনে পুজো হয়ে আসছে আন্দুল রাজবাড়িতে। সেই কামান আজ একেবারে চুপ করে গেছে, বন্ধ হয়েছে বলিও। যুগের নিয়মে চলতে চলতে রাজবাড়ির আঙিনায়ও আঁচড় পড়েছে অনেক।