সম্পাদকীয়

আড্ডা

Bengali gossip

Truth Of Bengal: অরূপ শঙ্কর মৈত্র: আড্ডা এক্কেবারে দিশি শব্দ। বাংলায় তো বটেই, হিন্দিতেও চলে। শব্দেও, অর্থেও। খুব সম্ভব পৃথিবীর সবচেয়ে আড্ডাবাজ জাত বাঙালি। সুযোগ পেলেই আড্ডা। আর আড্ডা মানেই গালগল্প, পিএনপিসি। আরবি ভাষায় গযব বলে একটা শব্দ চালু আছে। বাংলায় এসেই গুজব হয়ে গেল। শুধু গুজব হয়ে গেল তাই নয়, একেবারে ঘরে ঘরে গিয়ে গেড়ে বসল। এমন আড্ডা হবেই না, যেখানে গুজব নিষিদ্ধ।

আগে আড্ডা হতো রকে, ঘাটে, মাঠে, হাটে, কলতলায়, পুকুরপারে, কালাদার চায়ের দোকানে। ইদানিং আড্ডা জমে ফেসবুকে, হোয়াটস্যাপে, ইনস্টাগ্রামে, টুইটারে। গুজবের রমরমা। সোশ্যাল মিডিয়ার নেতৃত্বে ‘গণবিপ্লব’, ‘জনজাগরণ’ও হয়ে যাচ্ছে। আড্ডার নতুন নাম হয়েছে ‘চ্যাট’। চ্যাটাং চ্যাটাং কথা। কথা মানে লেখা। অবশ্য অনেক সময় ওয়েবিনার হয়। আড্ডার নতুন নাম: ওয়েবিনার। এই নয়া ফর্ম এখন আন্তর্জাতিক।

ধরা যাক, কাল্পনিক এক নতুন সোশ্যাল গ্রুপ। ‘বাংলাকথা’। অনিরুদ্ধ সিনিয়ার সিটিজেন। থাকে অস্ট্রেলিয়ায় সিডনিতে। সে একটা ছবি পোস্ট করে চ্যাট শুরু করেছে। ধরে নেওয়া যাক, এটা একটা কাল্পনিক মানচিত্র। বায়ুমণ্ডলে দূষণ আর ক্রমাগত উষ্ণতাবৃদ্ধির কারণে যদি হঠাৎ উত্তর বা দক্ষিণ মেরুর জমা বরফ গলতে শুরু করে, তাহলে সমুদ্রের জলস্তর উঁচু হতে শুরু করবে। সেক্ষেত্রে বাংলার বেশ কিছু অংশ সমুদ্রের গ্রাসে চলে যাবে। যে অংশ প্রথমেই ডুবে যাবে সেই অংশটাই মানচিত্রে হালকা নীল রঙে দেখানো আছে। পৃথিবীর দূষণ বা উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য দায়ী যেই হোক, তার খেসারত দিতে হবে বাংলাকে। বাংলা আজন্মকাল খেসারত দিয়ে এসেছে।

এবার কল্পনা করা যাক প্রাগৈতিহাসিক যুগে বাংলার এই অংশগুলো এইরকমই সমুদ্রগর্ভে নিমজ্জিত ছিল। পরে সমুদ্রের জলস্তর নেমে এইরকম এখানে মাটিতে পা রাখা গেল, তা কিন্তু নয়। জলস্তর যাওয়ায় বা নামলেও সেটা ধর্তব্য নয়। এই যে ময়মনসিংহ থেকে হাশোল, পূর্ব মেদিনীপুর থেকে ঢাকা জলের নীচে ছিল, এরা তাহলে অরিগাছল কী করে? আসলে গঙ্গা আর ব্রহ্মপুত্র বিপুল পরিমাণ পলি বয়ে এনে এনে সমুদ্র ভরাট করেছে। সঙ্গে তাল মিলিয়েছে মেঘনা। ঠিক যেমন প্রোমোটার জলাভূমিতে মাটি, বালি ফেলে ফেলে ভরাট

করে হাইরাইজ বানায়। সেই যুগে গঙ্গা আর ব্রহ্মপুত্র ঠিক আজকের মুর্শিদাবাদ-রাজশাহী রঙপুরের কাছে এসে সমুদ্রে মিশেছিল। এই মিশে যাওয়ার আগে তাদের যাত্রাপথের সমস্ত অঞ্চল ছিল ঢালু। ফলে বিপুল স্রোতে পলি বহন করতে করতে এসে হঠাৎ সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়ে সমস্ত পলি নামিয়ে দিচ্ছিল সমুদ্রে। গড়ে উঠতে শুরু করল নতুন নতুন চর। একসময় সেই চরগুলো জোড়া লাগছে, আবার ভাঙছে। এইভাবে অবিরাম ভাঙাগড়ার মধ্যে দিয়ে এই ভাটি এলাকা, বা সংস্কৃত ভাষায় নাব্য এলাকা অথবা ভূগোলের ভাষায় পৃথিবীর বৃহত্তম ডেল্টা বা ব-দ্বীপ গড়ে উঠল। আজও সেই ব-দ্বীপ অস্থির। আজও নতুন নতুন চর তৈরি হয়।

স্কুলে মানচিত্র দেখে পড়াশুনো করে বড় হয়ে শিক্ষক হয়ে সেই স্কুলেই পড়াতে এসে দেখে মানচিত্র বদলে গেছে। নদীর একূল ভাঙে ওকূল গড়ে এই তো নদীর খেলা। এই ব-দ্বীপই ছিল আদি বঙ্গ। পরবর্তীকালে বাংলা। মানচিত্রে পশ্চিমে তাকাও, ওটা রাঢ় এলাকা। উঁচু পার্বত্য অঞ্চল। বাঁকুড়া পুরুলিয়া, পশ্চিম বর্ধমান, বীরভূমের অংশ। ভারত ভূখণ্ডের টেকটনিক প্লেটের প্রান্ত দেশ। আবার ওপরে মালদা, দিনাজপুর গৌড় আর বরেন্দ্র বা পুণ্ড্র। এই অঞ্চলের মাটি নদীর পলি দিয়ে গড়া হলেও শক্ত পোক্ত হয়ে গেছে।

বঙ্গের মতো সমতল নয়। আর একটু ওপরে গেলেই হিমালয়ের পাদদেশে পৌঁছে যেতে হবে। এই বঙ্গের বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স ছিল পশ্চিমে গঙ্গা, পুবে মেঘনা, উত্তরে ব্রহ্মপুত্র। কালে কালে এই বাংলাই উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম মিলিয়ে সারা বাংলা হয়ে উঠল। অথচ এই কাদামাটির বাংলায় মানুমেলিয়ে পড়েছে সবার শেষে। পশ্চিমের পাহাড়ে ছিল প্রোটোঅস্ট্রালয়ে পা পুবের পাহাড়ে প্রোটোমঙ্গোলয়েড। এরা মূলত ছিল পশুশিকারী আর খাদ্য সংগ্রাহক। আর ব-দ্বীপ? জনমানবশূন্য।

হয়তো সামান্য কিছু যাযাবর বেদে ছিল। সত্যিকারের বসতি শুরু হল কবে? রহস্য! হয়তো সিন্ধু সভ্যতার অবলুপ্তির পর। হয়তো ওখানকার বসবাসকারীদের একটা অংশ এখানে এসে পৌঁছেছিল। তারা দ্রাবিড়। তারা এসে এই ব-দ্বীপে সিন্ধুসভ্যতার নতুন সংস্করণ শুরু করল। সেই কৃষিসভ্যতা। আঞ্চলিক অর্থনীতি দ্রুত উন্নতি করতে শুরু করল। অর্থনীতিই রাজনীতির নিয়ামক হয়। তাই কালে কালে পশ্চিমের রাঢ়, উত্তরের পৌণ্ড্রও বাংলার অংশ হয়ে উঠল। সিন্ধু সভ্যতা থেকে কৃষি, চাকালাগানো গাড়ি, তামার সঙ্গে টিন মেশানো ব্রোঞ্জ এখানে এসে সামান্য বদলে (টিনের পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়ে) কাঁসা হয়ে গেল।

পরিযায়ীদের সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের কারিগরি জ্ঞানও এল। ছোট ছোট পাগান বিশ্বাসের দেবতারাও সঙ্গে এসে হাজির। আরও দুটি জিনিস এল। সে দুটি হল সিন্ধুসভ্যতার সামাজিক মনের (সোশ্যাল সাইকি) এক বিচিত্র গঠন। খুব সম্ভব পৃথিবীর উন্নত আর কোনও সভ্যতায় তা ছিল না। সিন্ধু সভ্যতার সমসময়ে সারা পৃথিবীতে আরও অনেকগুলো সভ্যতা ছিল। অর্থনীতি, সামাজিক গঠন থেকে নগরব্যবস্থা সবদিক দিয়ে এদের মধ্যে সবচেয়ে উন্নত ছিল সিন্ধু। আকারে আয়তনেও সবচেয়ে বড়। প্রাথমিক আন্দাজ বলছে জনসংখ্যা ছিল প্রায় দশলক্ষ।

কিন্তু অন্য অন্য সভ্যতার দুটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান এই সভ্যতায় ছিল না। এক, কোনও বৃহৎ উপাসনালয় ছিল না। বৃহৎ, যেখানে দলবদ্ধভাবে বহুজন এসে একত্রিত হয়ে উঁচু জায়গায় উপাসনা করে। বিমূর্ত ঈশ্বরের অবস্থান হয় মহাকাশে। আর ছিল না কোনও বিশাল রাজপ্রাসাদ। অর্থাৎ একেশ্বর ছিল না, রাজাও ছিল না। তাহলে? তাহলে প্রশাসন ছিল বিকেন্দ্রীভূত, অর্থনীতি, সংস্কৃতিও তাই। রাজপ্রাসাদের প্রবেশদ্বারে দুপাশে দুটো থামের ওপর বসানো থাকে আর্ক। রাজপ্রাসাদ না থাকলে নো আর্ক। অ্যানার্কি। রাজা নেই। রাজপ্রাসাদ নেই। প্রবেশদ্বার নেই। নৈরাজ্য।

রাজা নেই, মানে যুদ্ধ নেই। প্রায় তিন হাজার বছরের সিন্ধুসভ্যতায় কোনও রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়নি? উলুখাগড়ার প্রাণ যায়নি? না। সিন্ধু সভ্যতায় মারাত্মক কোনও যুদ্ধাস্ত্র পাওয়া যায়নি, যুদ্ধের লেশমাত্র চিহ্ন পাওয়া যায়নি। ধুস! তাহলে আর সভ্যতা হল কী করে? যুদ্ধ না থাকলে ইতিহাস হয়? আজও মূলনিবাসি বাঙালি সেই একই মানসিকতা নিয়ে চলেছে। একটু খেয়াল করলেই দেখবেন, সেই যুগের ভৌগোলিক বঙ্গের সঙ্গে রাঢ় বা গৌড়ের আজও অনেক অনেক গরমিল রয়ে গিয়েছে। আছে একমাত্র ভাষার ঐক্য। তাও এত ডায়ালেক্টের বৈচিত্র্য আর কোনও ভাষায় আছে কিনা সন্দেহ। পুবে চাটগাঁইয়া থেকে পশ্চিমে সাঁওতালি, দক্ষিণে দোখনে থেকে উত্তরে শেরশাহবাদি। এই নৈরাজ্যই বাঙালির সম্পদ। আবার আপদও। এই পোস্ট হওয়ার পরেই জনৈক অনিন্দ্য পোস্ট করল।

অনিন্দ্য-

– বাঙালি নৈরাজ্যবাদী? অ্যানার্কিস্ট?

হ্যাঁ। (অমনি চ্যাট শুরু হয়ে গেল।)

মানে?

মানে অ্যানার্কিস্ট।

কারা অ্যানার্কিস্ট?

– বাংলার মূলনিবাসীরা। যারা শ্রমজীবী। ভূপ্রকৃতি যাদের ক্ষ্যাপা বাউন্ডুলে করে তুলেছে।

আর অন্যরা?

রাজ্যবাদী।

রাজ্যবাদী আবার কারা?

রাজ্যবাদী তারা, যারা শৃঙ্খলা পছন্দ করে। যারা পরশ্রমজীবী। যারা শ্রমকে ঘৃণা করে। রাজা থেকে রাজ্য। না-রাজা থেকে নৈরাজ্য।

রাজ্যবাদ-নৈরাজ্যবাদ। একটা ডাইকোটমি।

ডায়ালেকটিকস। ইউনিটি অব অপোজিটস।

এই শালা, মার্ক্স ঢুকে পড়েছে রে। ডায়ালেকটিক্স। মানেই পলিটিক্স।

না, না, ভয় নেই। মার্ক্স এই জলাজঙ্গলে আসবে না।

ডিভিশন অব লেবার?

না।

-না কেন? সারা পৃথিবী জুড়েই একদল শ্রমজীবী, আর একদল পরশ্রমজীবী। ইওরোপ, আমেরিকা সব জায়গায় ডিভিশন অব লেবার আছে।

আছে, সেটা বংশপরম্পরায় নয়। আর তারা শ্রমকে ঘৃণাও করে না। দরিদ্র ব্রাহ্মণ, খেতে পাচ্ছে না, তবু হাল-বলদের কাজ করবে না। যজমানি করে পেট চালাবে। একটা মজার কার্টুন মনে পড়ছে। বিশাল কোম্পানির মালিক প্রত্যেকদিন সন্ধ্যাবেলায় রাস্তায় ধুপকাঠি ফেরি করেন।

একদিন অফিসের একজন জুনিয়র স্টাফ দেখতে পেয়ে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, এ কি স্যার? আপনি রাস্তায় ধুপকাঠি ফেরি করছেন? মালিক বলল অভ্যাসটা রাখছি, যদি আবার কোনদিন পুরোনো পেশায় ফিরে যেতে হয়। সম্ভবত আর কে লক্সমনের কার্টুন। স্টেট ব্যাঙ্কের ২৫ বছর পূর্তিতে এঁকেছিলেন।

ভারি মজা তো!

মজা এখানে, আমাদের দেশে। এখানে আজকে রাজা কালকে ফকির হতেই পারে, ভিক্ষেও করতে পারে, আমাদের বৈদিক শাস্ত্রে ভিক্ষে জায়েজ, কিন্তু হারগিস লাঙল কিংবা হাতুড়ি ধরবে না। ক্লাসে মবিলিটি হয়। কাস্টে হয় না। এদেশে ক্লাসের চেয়ে কাস্টের গুরুত্ব বেশি। বংশপরম্পরা। চোদ্দপুরুষ কথাটা এই জন্য আমাদের সোসাইটিতে এত গুরুত্বপূর্ণ।

তার মানে এখানে বাঙালি দুই প্রকার। রাজ্যবাদী ও নৈরাজ্যবাদী।

রাজ্যবাদীদের আমার বাঙালি বলতে একটু অস্বস্তি হয়। বলা যায় বাঙালি পরিচয়টা এরা চুরি করেছে।

রাজ্যবাদী, নৈরাজ্যবাদীরা এখানে কি বরাবরই ছিল?

না, রাজ্যবাদীরা বাংলায় বহিরাগত।

কতদিন আগে এসেছে?

আমার হিসেবে বাংলায় স্টেটিস্ট বা রাজ্যবাদীরা ম্যাক্সিমাম দেড় থেকে দু’হাজার বছর আগে এসেছিল। তার আগে ওদের কাছে বাংলা ছিল একেবারেই ব্রাত্য এলাকা। বলে রাখি, সেযুগে বাংলা বলতে শুধু দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গ বোঝাত। মূলত ভাটি এলাকা। গঙ্গা থেকে মেঘনা। সেযুগে পৌণ্ড্র বা বরেন্দ্রভূমি যা পরবর্তীকালে গুড়ের জন্য গৌড় নামে বিখ্যাত হয়েছিল আর রাঢ় অঞ্চলকে কিন্তু বাংলার অংশ ধরা হতো না।

কিন্তু আমরা তো শুনেছি গৌড়বঙ্গ, রাঢ়বঙ্গের কথা।

সেই যুগের কোনও সাহিত্য, সে বৈদিক পুরাণ হোক অথবা, বিদেশিদের ভ্রমণকাহিনি হোক, পাণ্ডুলিপি শিলালিপি কোথাও গৌড়ের সঙ্গে বা রাঢ়ের সঙ্গে বঙ্গ শব্দটা নেই। আছে সমতট এবং বঙ্গের আলাদা করে উল্লেখ। যেখানে তট সমান হয়ে যায়, সেটাই সমতট। অর্থাৎ ভাটি বা নাব্য এলাকা। সম এবং তট এই আর্যভাষার প্রয়োগ বলে দেয়, এই নামকরণ কাদের। এলাকার নামকরণ সাধারণত বাইরের বাসিন্দারা করে। কই যাস? লস্করহাট কিংবা সাতগাছিয়া। সাতটা গাছ থাকার কারণে স্থানীয় বাসিন্দারা মিটিং করে সাতগাছিয়া নামকরণ করেনি। যারা বাইরে থেকে আসছে, সাধারণত বণিকেরা, তাদের মনের মানচিত্রে জায়গাটা সাতটা গাছের চিহ্ন হিসেবে সাতগাছিয়া হয়ে গেছে। আমরা অনেকেই জানি না, আফ্রিকা নামটা আফ্রিকানদের দেওয়া নয়, আফ্রিকার বাইরের অধিবাসীদের। যেমন হিন্দুস্তান নামটা। সেইযুগে বঙ্গ ছিল ব্রাত্য এলাকা।

ব্রাত্য কেন?

এখানে মেয়েরা ব্রত উৎযাপন করত। মেয়েদের এত সাহস তারা পুজো করে! তাদের চোখে বাংলায় থাকত সরু সরু ঠ্যাংওয়ালা পক্ষীর দল। কিচিরমিচির করে পাখির ভাষায় কথা বলে।

কেউ আসত না কেন?

নিষিদ্ধ এলাকা তাই।

কেন নিষিদ্ধ?

যেমন আমাদের কাছে সুন্দরবনের গভীর জঙ্গল নিষিদ্ধ।

কেন? কারণ সেখানে মানুষ খেকো বাঘ আছে। এখানে সাপখোপ, জোঁক, বিছে, মৌমাছিদের অবিরাম লীলা চলছে। উত্তরের রাজ্যবাদী পরশ্রমজীবীদের মতে এই বাংলা ছিল ইতর অসভ্য-বর্বর অসুর, ডাকাতদের এলাকা।

এমন ভয়ঙ্কর দুর্গম জল কাদা নদী-খাল-বিল-দহ-সাগরে মানুষ থাকতে পারে? পাছে কেউ ভুল করে চলে যায়, তাই বলা হতো ওখানে গেলে পতিত হয়ে যেতে হবে। ফিরে আসতে হলে প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। তাদের কথা রবীন্দ্রনাথ গানে বলেছেন,

“চলো নিয়ম-মতে।

দূরে তাকিয়ো নাকো, ঘাড় বাঁকিয়ো নাকো, চলো সমান পথে।

হেরো অরণ্য ওই, হোথা শৃঙ্খলা কই? পাগল ঝর্নাগুলো দক্ষিণপর্বতে।

ও দিক চেয়ো না, চেয়ো না, যেয়ো না, যেয়ো না, চলো সমান পথে।”

শকুন-টকুন ভাবত নাকি? হাড়গিলে?

ইন্টেরেস্টিংলি হাড়গিলে জাতীয় শকুনদের ম্যাক্সিমাম দেখা যায় কিন্তু এই সাউথ-ইস্ট-এর বাংলা আসাম বার্মা অঞ্চলগুলোয়।

তাহলে এখানে হঠাৎ এই রাজ্যবাদীদের আসা শুরু হল কী করে?

খবর পৌঁছে গেছিল এই বাংলা সাংঘাতিক উর্বরা আর প্রচুর সম্পদ। সোনার বাংলা। প্রথমে বণিকদের নজরে পড়ল। অর্থাৎ বৈশ্যদের। তারা ছুটে এলো। কিন্তু দুর্গম প্রান্তিক অঞ্চলগুলোতে, ভিতরে প্রবেশ করে, সে সাধ্য ছিল না একেবারে। তাই প্রান্তে প্রান্তে বাণিজ্য নগরী।

তারপরে বণিকদের বাণিজ্য করার প্রয়োজনেই ক্রমশ এখানে শাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রয়োজন হল। বণিকের মানদণ্ড দেখা দিল রাজদণ্ডরূপে পোহাল শর্বরী। রাজদণ্ডের সঙ্গে রাজদণ্ড চালানোর জন্য দরকার হয়ে পড়ল প্রশাসকের দল। সে আমলের আইসিএস, ডব্লিউবিসিএস, আইপিএস অফিসার। এবং বৈদিক ব্রাহ্মণদের ওই উত্তর থেকে নানা উপঢৌকন দিয়ে নিয়ে আসতে হল। তারা এসে এখানে রাজ্য বা স্টেটহুড প্রতিষ্ঠা করল।

স্টেট কিংবা রাজ্য অথবা রাষ্ট্র আমাদের খুব চেনা। বাড়ি থেকে বেরোলেই আমাদের রাজ্যের সঙ্গে দেখা হয়। কখনও রাস্তার মোড়ে ট্রাফিক পুলিশ। একটু পরেই থানা। মন্ত্রীর কনভয়, পঞ্চায়েত অথবা নানা সরকারি নির্দেশ, আধার থেকে বার্থ সার্টিফিকেট। কিন্তু নৈরাজ্যবাদ, যেটা তুমি বলছ এক সময় এখানকার মূল ধারা ছিল, সেটা ঠিক পরিষ্কার হচ্ছে না।

যদি আমরা সমাজ সমুদ্রের গভীরে যাই, তাহলে দেখব নৈরাজ্যবাদের টানা চোরাস্রোত। এই নৈরাজ্যবাদ রাজ্যবাদীদের চক্ষুশূল। তাই তারা নৈরাজ্য বা অ্যানার্কি শব্দটাকে নিন্দার্থে ব্যবহার করে।

এই পাখির দলের নৈরাজ্যবাদের আর একটু বোধ হয় ব্যাখ্যা দরকার।

ব্যাখ্যা একটাই। বাসা।

বাসা মানে?

বাসা মানে বাসা। আমরা যেখানে থাকি।

-হ্যাঁ। বাড়িকে বাসা বলে বাঙালরা। আমরা ছোটবেলায় বাবা ঠাকুরদার মুখে বাসা শব্দটা বার বার শুনেছি। পদ্মাপারে কোথায় যেন আমাদের বাসা আছিল।

বাঙালরাও বাড়ি বলে ‘হোম’ অর্থে। আর রেসিডেন্স অর্থে ‘বাসা’। বেটার শেল্টার। আশ্রয়। শেল্টার সবসময় টেম্পোরারি হয়। এখানে বাসাও টেম্পোরারি। ওই যে দেখা যাচ্ছে দূরে, মরা নদীর পাশে ছোট্ট একটা কুঁড়ে। ওটা আমার বাসা। একটা ভালো বাসার খোঁজেই সারাজীবন ছোটা। ভালোবাসা।

– এখান থেকেই বোধহয় লাভ, প্রেম অর্থে ‘ভালোবাসা’ এসেছে তাই না?

– হ্যাঁ। বাংলার পাগল প্রকৃতি কিছুতেই এই ভালোবাসা স্থায়ী হতে দেয় না। বাসা ভেঙে যায়, ভালোবাসা হারিয়ে যায়! আবার নতুন করে অন্য জায়গায় গিয়ে বাসা বাঁধতে হয়। যেহেতু নৈরাজ্যবাদী শ্রমজীবী বাঙালি ভালোবাসা খুঁজে বেড়াত, তাই উনিশ শতকে ভালোবাসা শব্দটাই অশ্লীল ছিল রাজ্যবাদীদের কাছে। ভূপ্রকৃতির এই নৈরাজ্যই আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে নৈরাজ্য সৃষ্টি করে। আমরা এই কিচিরমিচির পাখির দলের জীবনের নিশ্চিন্ত স্থায়ী ঠিকানা, জানি এই আশ্রয় সম্ভব নয়। আর স্থায়িত্ব না থাকলে রাজ্য হয় না। আমাদের পাল্লীগীতির মধ্যে বারবার এই ভাবনাটা ফুটে উঠেছে। “লোকে বলে বলে রে ঘরবাড়ি ভালা নাই আমার। কি ঘর বানাইমু আমি শূন্যের ও মাঝার।”

– আধুনিক গানেও এমন ভাবনা কিন্তু আছে। “দুটি পাখি দুটি তীরে, মাঝে নদী বহে ধীরে।” একই তরু শাখা পরে

ছিল বাধা লীলা ভরে অজানা সে কোন ঝড়ে ভেঙে নিল বাসাটিরে বিধাতার আভিশাপ নিয়তির হল জয় ছিঁড়িল বীণার তার মুছে গেল পরিচয় ছিল যেথা আলো হাসি ফুলদল মধু বাঁশি আজি সেথা কিছু নাহি বায়ু কেঁদে যায় নীড়ে দুটি পাখি দুটি তীরে মাঝে নদী বহে ধীরে তালাত মাহমুদের গান!

তপন কুমারের গান!

তপন কুমার? আমি তো জানতাম তালাত মাহমুদ!

– তপন কুমারই তালাত মাহমুদ। সে যুগে গায়কের নাম হিন্দু হলে রেকর্ড বেশি বিক্রি হতো।

কেন?

সে যুগে অবস্থাপন্ন লোকের বাড়িতেই গ্রামাফোন রেকর্ড থাকত। আর বেশিরভাগ অবস্থাপন্ন ছিল বর্ণহিন্দু জমিদার শ্রেণির লোক। ভালাত মাহমুদ এই মুসলমান নামে তারা হয়তো রেকর্ড নাও কিনতে পারে। যে কারণে শ্যামা সঙ্গীত, কীর্তন শিল্পী মুন্সী মহম্মদ কাসেম ‘কে মল্লিক’ নামে গান গাইতেন।

-আব্বাসউদ্দীন তো “আল্লাহ মেঘ দে পানি দে” গান গেয়েছিলেন আব্বাসউদ্দীন নামেই।

সেটা হয়তো ওই আল্লাহ আর পানি এই দুটো শব্দের জন্য। একটা মজার ঘটনা বলি। দক্ষিণ ২৪ পরগণার কোনও একটা স্টেশনে একদল ছাত্র, হয়তো যাদবপুরের ছাত্র, অপেক্ষা করছে ট্রেনের জন্য। ওরা চুটিয়ে আড্ডা মারছে। এমন সময় ওই স্টেশনেরই এক পানবিড়ির দোকানে রেডিওতে গান বেজে উঠল, “আল্লাহ মেঘ দে, পানি দে”। অমনি একটা ছেলে বলে উঠল, “দেখ, দেখ, বাংলাদেশের গান, আমাদের এখানকার গানের সুর ঝেড়ে দিয়েছে।” তো, অপর ছেলেটি বলল, “কোন গানটা ঝেড়েছে রে?”

কেন? ‘মুঝে পেয়ার দে পেয়ার দে পেয়ার দে রে মুঝে…’ শুনিসনি?

আরেঃ, মুঝে পেয়ার দে গানের সুরটাই তো আল্লা মেঘ দে থেকে ঝাড়া।

অমনি একগুচ্ছ হাসির ইমোজি এসে গেল। এইখানে এসে চ্যাট থেমে গেল। আপাতত।

চ্যাট চলবে।

সৈজন্যে: কণ্ঠস্বর

Related Articles