সম্পাদকীয়

বাঙালির আরেক নাম আবেগ

Another name for Bengalis is passion

Truth Of Bengal: বাবুল চট্টোপাধ্যায় (বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক): বলছি বাঙালির কথা। বাঙালি মাত্রই আবেগপ্রবণ কিন্তু কেন এত আবেগ এই প্রশ্নটাই তো ঘুরপাক হয় মনের মধ্যে। আসলে মনে হয় বাঙালির মধ্যে সুন্দর একটা মন আছে। যা তাকে এত আবেগপ্রবণ করে তোলে। আর এই আবেগ প্রবণতা অন্য কোনো সংস্কৃতির মানুষের মধ্যে তেমন দেখা যায় না। এখনও আমাদের ভাষা, আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের রুচিবোধ, আমাদের শিক্ষা, আমাদের মূল্যবোধ সহ নীতি, ধ্যান ধারণা অনেক উঁচু স্থানে। ভুল বললাম। অনেক উঁচু পর্যায়ের। ঠিক এই কারণেই আমরা আমাদের জাতিকে নিয়ে গর্ববোধ করতে পারি। আমাদের একটা নেতাজি আছে।

আমাদের একটা স্বামীজি আছে। আমাদের আছে গান্ধীজি, রবীন্দ্রনাথ। এরকম কত মনীষী আমাদের বাঙালি সংস্কৃতির উজ্জ্বল নক্ষত্রে বসবাস করছেন তার ইয়াত্তা নেই। আমরা সেই সংস্কৃতির ধারক। বাহক ও বটে। তাই আমাদের মধ্যে কেন জাত্যাভিমান থাকবে না বলুন তো! আমাদের আবেগই বা কেনো থাকবে না। আমরা যা পারি অন্য কোনো সভ্যতা তা পারে না। ভুল বললাম। এভাবে পারে না। না তাও ভুল হলো। সে ভাবে পারে না। আপনি হয়তো বলবেন ঠিক বুঝলাম না। আমি বলবো আপনি একটু বোঝার চেষ্টা করুন না, ঠিক বুঝবেন। দেখুন তো এমন কোন ক্ষেত্র আছে যেখানে বাঙালি বিরাজ করেন নি। আবেগ না থাকলে তা তো কোনোভাবেই সম্ভব নয়।

আমি হলপ করে বলতে পারি অন্য কোনো জাতি হলে এই আর জি কর কান্ডতে এভাবে সাড়া পড়ত না। এটা সম্ভব হয়েছে বাঙালি বলেই। মানে বাঙালির সেন্টিমেন্টের জন্যেই। নিন্দুকেরা হয়তো অনেক কথা বলবেন কিন্তু না বাঙালি বলেই এত ও যত স্বতস্ফূর্ততা দেখা গেছে অন্য কোনো ক্ষেত্র হলে তা দেখা যেত না। যার রেশ এখনও চলছে। চলার-ই কথা। এমন নারকিয় ঘটনা বাঙালি মেনে নিতে পারেননি। অন্য কোনো জাতিও তা মেনে নিতে পারবে না। পারে ও নি। না পারার-ই কথা। তবে বাঙালি বলেই আন্দোলন টা এতো চড়া হয়েছে সেকথা নিন্দুকেরা ও স্বীকার করবেন। তবে আবেগ কমবেশি সকলেরই চেনা। আর সেটা নারকীয় বা মর্মান্তিক হলে তো কোনো কোথায় -ই নেই। তবে আসলে এই ছবি আমাদের চেনা নয়। আসলে এটা কোনো চেনা ঘটনাও নয়, এটা সম্পূর্ণ অচেনা ঘটনা আমাদের এই শহরে আছড়ে পড়েছে।

আমাদের এই সংস্কৃতিতে এই ঘটনা অভিনব শুধু নয়, একেবারেই অপ্রত্যাশিত। আপনার আমার বিবেক সেটা মেনে নিতে পারেনি। তাই আমাদের এত আন্দোলন, তাই আমাদের এত প্রতিবাদ। তাই এত মানব বন্ধনও। মানুষ এটা মেনে নিতে পারেনি। আরও ভালোভাবে বললে বাঙালি এটা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেননি। কারণ বাঙালির আবেগ অন্য জাতির তুলনায় অনেক বেশি। তাহলে আবার প্রশ্নও উঠবে অন্য কোনো জাতি কি এই আবেগে সাড়া দেন নি। অবশ্যই দিয়েছে। তবে অনেকটাই বাঙালিতে এর রূপরেখা ধরা দিয়েছে – এতে কোনো সন্দেহ নেই।

কিছুদিন আগেই গেলো দুর্গাপুজো। আপনি আমি সবাই সেখানে কি সুন্দর আনন্দে কাটালাম। কোনো কষ্ট, কোনো দুঃখও আমাদের মধ্যে একেবারেই দেখা যায় নি। কেন জানেন ? কারণ বাঙালির একটা সুন্দর মন আছে। এবার যদি একটা সুন্দর মন থাকে তবে তো একটা সুন্দর আবেগও তাকে নিয়ন্ত্রণ করবে সেটাই স্বাভাবিক। এ তো গেলো একটা জাতির একটা ফ্রেন্ডলী শহরের চেনা চেহারা। আবেগটা ধরা পড়ে অন্য জায়গায়। অঞ্জলিতেও অভয়ার বিচার চেয়েছেন অনেকেই। আপনি হয়তো জানেন না এবারের কোনো এক পুজোর থিম সং কোনো এক শিল্পী বিনা পয়সায় গেয়েছেন। কারণ এ তো মায়ের গান। তাই পয়সা নয়। আপনি হয়তো জানেনই না যে ঠাকুর তৈরি করেন কোনো একটা ক্ষেত্রে সে নিজ পয়সায় মাকে সাজিয়েছেন। কারণ তিনি মা। সবার মা।

সেই পালের নিজের মা চলে গেছেন অনেক আগেই। তাই সে নিজের মাকে না পেয়ে মৃন্ময়ী মাকে সকলের অলক্ষ্যে কিছু দিয়ে সাজিয়ে থাকেন প্রতি বছরেই। ভাবুন একবার। কি অবস্থা জানেন সেই বায়না করা ছেলেটার। যে কিনা তেরোটা পুজোর পোশাক পেয়েও খুশি কারণ চোদ্দটা অভাবী বন্ধুকে ঠিকমতো পোশাক গত পুজোয় গিফট করতে পারবে না বলে। না, অবশেষে পেরেছে। মাটির ভাড় এ জমানো পয়সা থেকে সব সম্ভব হয়েছে। বলুন তো আবেগ না থাকলে তা সম্ভব হতো! কখনোই নয়। আর আরও বলতে পারি বাঙালি বলেই তা সম্ভব হয়েছে। আর সেই ব্যক্তিকে তো আমি চিনি যে কিনা মায়ের মুখ দেখেন না অথচ মাকে কাঁধে করে প্রতিমা নিরঞ্জন এ নিয়ে যেতে তৈরি হন সবার প্রথমে। বলে, আমি মাকে না দেখলেও চলবে কিন্তু মা তো আমাকে দেখছেন। মা তো মহামায়া। আর শ্যামাপুজো নিয়ে এক কবি লিখছেন-

পায় না খেতে ফুর্তি বেজায়/ বুদ্ধিজীবী বলে, খুশি হবে গরীব বলে /আনন্দ ভাগ হলে!
ভাবুন আরও একবার – কি বললেন কবি! কতটা আবেগ জড়িয়ে বাঙালি কবির কথায়!
এরপর ভাবুন ভাইফোঁটার দিনের কথা। এটা তো আবেগের দিন। একজন ট্রাফিক সার্জেন্ট হেলমেট ছাড়া ধরেছেন এক মহিলা স্কুটি চালককে। সরকারি মতে – হাজার টাকা ফাইন। সার্জেন্ট সাহেব অনেকক্ষন মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলেন। পরে কোনো কথা না বলে ছেড়ে দিলেন। কিন্তু কেনো অন্য আরেক সার্জেন্টের ছেড়ে দেওয়ার প্রশ্নে উনি বলেন -ওকে দেখতে আমার ছোট বোনের মত। ও নেই। আমার এই বোনটা না হয় আজ আমরা থেকে ফাইন নাই বা খেলো, কি এল গেল ! আর হয়তবা মনে মনে ভাবলেন আমার নিজের বোনটা না থাকাটাই তো ফাইন।

ভাবুন একবার আইন রক্ষকদেরও কিছু ক্ষেত্রে কত আবেগ! আসছি আরেকটি ঘটনায়। ছয় ভাইবোনই বাইরে থাকেন। তবে ভাইফোঁটার দিন মিলিত হন। স্মৃতিগুলো সব উঁকি মারে আবেগে। একে অপরে বহু কথা,হৈ হুল্লোর হয় যার মূল সুর – ভাগ্যিস বাঙালি হয়ে জন্মেছিলাম! কবি আবারও লিখে বসলেন –
কত আবেগ জড়িয়ে আমার ভাই ফোঁটায়
যতদূর মনে পরে ততদূর বলা যায় …!
কবির কত দূর মনে পড়ে জানি না, তবে এটা বুঝি কবি আসলে বাঙালি আবেগেই বেড়ে ওঠা এক দিব্য সময়।

এমন কোনো ভালোবাসা নেই যেখানে বাঙালির আবেগ নেই। সে মানব বন্ধন হোক বা মাঠের মহসিনে। বাঙালি সব সময় তৈরি। মাঠের লড়াইয়ে এক ইঞ্চিও জায়গা ছাড়তে রাজি নন বাঙালি। লড়াই তৈরি। ইস্টবেঙ্গল বা মোহনবাগান। মানে ইলিশ না চিংড়ি। মানে ঘটি না বাঙ্গাল। লড়াই শেষ হলে জানবেন – আসলে ভালোবাসা। এই হল বাঙালিয়ানা আবেগ। এই আবেগকে ধরে রাখা চাট্টিখানি কথা নয়। বাঙালি তা পেরেছে। আর পেরেছে বলেই বাঙালি আজ সমস্ত জাতির থেকে সম্মান আদায় করে নিয়েছে। আর বাঙালির আবেগ আছে বলেই তো সেটা সম্ভব। আমদের আবেগ আমাদের সম্পদ। আমাদের আবেগ আমাদের সম্মান। আমদের আবেগ আমাদের অহঙ্কার।

আমরা মনে বাঁচি, আমরা মর্মে বাঁচি। আমরা ধর্মে বাঁচি, আমরা উৎসবে বাঁচি। আমরা বিবেকে বাঁচি, আমরা হৃদয়ে বাঁচি। আমাদের সব সভ্যতা আমাদের সংস্কৃতি আমাদের প্রতিটি মুহূর্তকে বাঁচাতে সাহায্য করে। এমন ফ্রেন্ডলী মানুষ আছে আর কোথাও! আমাদের একজন মহানায়ক( উত্তম কুমার) বা একজন দাদামনি (অশোক কুমার) চলচ্চিত্র চেনায়। একজন কিশোর কুমার সঙ্গীত চেনায়। একজন গোষ্ঠ পাল বা পি কে ব্যানার্জী খেলার আসর চেনায়। আরও কত কত কত। কী সাহিত্য কী সংস্কৃতি কী রাজনীতি সর্বত্র বাঙালি বিরাজমান। এখানে কোনদিকে বাঙালি নেই বলতে গেলে একটা প্রবন্ধে তা বলা অসম্ভব। কারণ হল বাঙালির তীক্ষ্ম বুদ্ধি, সৎ নিষ্ঠা ও অবশ্যই আবেগ। যা অন্য জাতির ক্ষেত্রে দেখা যায় না। কিছু অনুভূতিতে বাঙালি সর্বদায়ই সবল। এই ভাবাবেগ বাঙালি লালন পালন করে অতি যত্নে। অনেকদিন পরে দেখা হওয়া মানুষটার জন্যে কবি লিখলেন – তোমার সঙ্গে দেখা হবে সে তো জানা কথায়, তোমার সঙ্গ দেখা আমার মলিন বেদনায়! কি মানবেন তো?

Related Articles