সম্প্রীতির এক বিরল দৃষ্টান্ত বিরহীর মদনগোপাল
A rare example of harmony: Madangopal of Birhi

Truth Of Bengal: ইন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়: ধর্মের বেড়া ওদের আটকাতে পারেনি। তাই কারও ধর্মীয় উসকানি ও প্ররোচনায় ওরা পা দেয় না। ওদের সম্পর্ক অটুট, অটুট ওদের চিন্তাভাবনা। সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই। এই মন্ত্রেই তাঁরা বিশ্বাসী। তাঁরা বোঝেন ধর্ম বিশ্বাস, কর্ম জীবন। এহেন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক বিরল দৃষ্টান্ত নদিয়ার বিরহী গ্রাম। আর এই গ্রামেই নদিয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র ১৭৬০ সালে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মদনগোপালের মন্দির। যাকে আঁকড়ে আজও হিন্দু-মুসলমান একই বৃন্তের দু’টি কুসুমের মতো আবদ্ধ রয়েছেন। তাই প্রতিবছর মন্দিরের সামনে আজও গণফোঁটা আয়োজিত হয়।
যেখানে হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মানুষই অংশ নেন। যমের দুয়ারে পড়ল কাঁটা সঞ্জীবনী মন্ত্রে হিন্দু বোন যেমন ফোঁটা দিয়ে মুসলমান ভাইয়ের মঙ্গল কামনা করেন, তেমনই মুসলমান বোন হিন্দু ভাইকে ফোঁটা দিয়ে দীর্ঘায়ু কামনা করেন। এভাবেই এখানে হিন্দু ও ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষদের সহাবস্থান। বিরহী বাজার থেকে সামান্য দূরত্বে এই মন্দিরের সামনে দিয়ে বয়ে গিয়েছে যমুনা নদী। নদীর ওপারে রয়েছে ভোগের পাড় গ্রাম। অতীতে ওই গ্রাম থেকেই আসত ভোগের সামগ্রী। সে কারণেই গ্রামের নাম হয় ভোগেরপাড়া। নদীর ঘাটে রয়েছে সুবিশাল অশ্বথ্থ গাছ। যাক সুশীতল ছায়াতলে বিশ্রাম নেন দর্শনার্থী ও পথচলতি পথিক। বিশ্বাস ও ভক্তির টানে দূর-দূরান্ত থেকে আসা বহু মানুষ যমুনা নদীতে স্নান করে মন্দিরে পুজো দেন, মনঃকামনা পূর্ণের আশায় ভাড়া বাঁধেন অশ্বথ্থ গাছে।
মদনগোপাল মন্দিরকে ঘিরে অনেক গল্পগাঁথাই আজও মানুষের মুখে মুখে ফেরে। মদনগোপাল অর্থাৎ কৃষ্ণের পাশে একসময় রাধার মূর্তি ছিল না। মদনগোপাল বিরহে কাতর ছিলেন। আর এই রাধা-কৃষ্ণের বিরহ থেকেই বিরহী গ্রামের উৎপত্তি। পরবর্তীতে অবশ্য যমুনা নদীতে ভেসে আসা নিম কাঠ দিয়ে তৈরি হয় রাধার মূর্তি। আর এহেন বিষয়কে ঘিরে সেই সময় কোনও এক রসিক কবি গান বেঁধেছিলেন, “বিরহীর মদনগোপাল বউ ছেলে নেই পোড়াকপাল।”
একসময় এই বিরহী গ্রাম হালকা জনবসতি ও বিস্তীর্ণ জঙ্গলাকীর্ণ ছিল, এখনকার মতো আধাশহর হয়ে ওঠেনি। সোনাখালি গ্রামে বিহারী ও কমলা নামে এক গোয়ালা দম্পতির বাস ছিল। তাঁরা নিঃসন্তান হওয়ায় তাঁদের মনে অনেক দুঃখ ছিল, তাঁরা সিদ্ধান্ত নেন, বৃন্দাবনে যাত্রা করবেন। সেইমতো একদিন ভোরে তাঁরা বেড়িয়ে পড়েন। বনপথ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে জঙ্গলে ঘেরা এলাকায় আজ যেখানে মদনগোপালের মন্দির, তাঁরা সেখানে ক্রন্দনরত এক শিশুপুত্রকে কুড়িয়ে পান। স্বভাবতই তাঁদের আর বৃন্দাবন যাওয়া হয়নি। শিশুপুত্রকে পেয়ে তাঁরা খুবই খুশি। নিমেষে তাঁদের মনের সব কষ্ট ধুয়ে মুছে পরিষ্কার। শিশুপুত্রকে বুকে নিয়ে তাঁরা ফিরলেন বাড়ি। নাম রাখলেন গোপাল।
গোপাল দুধে-ভাতে বড় হতে থাকল, আর পাঁচটা রাখাল বালকের মতো সেও মাঠে গরু চড়াতে যেত। সেদিন ছিল রথযাত্রা। মাঠে বসেই সব রাখাল বালকরা হরিণঘাটায় রথ দেখতে যাবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু গরুগুলোকে দেখবে কে? রাখালরূপী কৃষ্ণ অর্থাৎ বিহারী ঘোষের পালিত পুত্র একাই সব গরুর দায়িত্ব নেয়। তারা সেদিন হালদার পাড়া গ্রামের মাঠে ছিল। গোপালের কথায় তারা আশ্বস্ত হয় এবং হরিণঘাটা যাত্রা করে। কিন্তু গরু চড়াতে চড়াতে গোপাল একসময় ক্লান্ত হয়ে গাছের ছায়ায় ঘুমিয়ে পড়ে। আর সেই সময় গরুগুলো কৃষকদের পাকা ধান ক্ষতি করতে থাকে।
আর তাই দেখে কৃষকরা লাঠি নিয়ে রে-রে করে ছুটে আসে গোপালের দিকে। নিমেষের মধ্যে গোপাল মাঠ সংলগ্ন কাঁঠালগাছের মধ্যে ঢুকে পড়ে। তাকে আর কোথাও খুঁজে না পাওয়ায় বিহারী ও তাঁর স্ত্রী কান্নাকাটি করতে থাকেন। কৃষকদের বক্তব্য, তাঁরা কৃষ্ণর দিকে লাঠি নিয়ে তেড়ে গিয়েছিল ঠিকই কিন্তু হাওয়ার মতো সে অদৃশ্য হয়ে যায়। তখনকার এক গীতিকার এ নিয়ে গান লিখেছিলেন, “মারিনিকো ধরিনিকো এতো বিষয় দায়, মেরেছিলাম লাঠি ছুঁড়ে ফোলেনিকো গায়।” সেইসময় ‘স্যাঁকফল’ বলে পরিচিত। অগ্রহায়ণে নতুন আমনধান উঠলে রাখালেরা এই গান গেয়ে চাল-পয়সা তুলত। তা দিয়েই হত মাঠের মধ্যে চড়ুইভাতি। কথিত আছে গোপালের নিরুদ্দেশ নিয়ে বিহারী ঘোষ নাকি সেই সময় কৃষকদের বিরুদ্ধে একটি আদালতে মামলাও করেন।
মদনগোপাল মন্দিরকে ঘিরে আজও বিরহী গ্রামের মানুষের মনে উন্মাদনা, বিশ্বাস ও নানা কাহিনি বিদ্যমান। আর একে ঘিরেই প্রতিবছর মন্দির প্রাঙ্গণে ভাইফোঁটা উৎসব ও মেলা অনুষ্ঠিত হয়। যেখানে জাতপাত, ধর্ম নির্বিশেষে মানুষ অংশ নেন। পাশাপাশি এখানে দোল ও জন্মাষ্টমী উৎসবও পালিত হয়। বর্তমানে মন্দির উন্নয়ন ও দেখভালের জন্য কমিটিও রয়েছে। বিরহী মদনগোপালের মন্দির এক সম্প্রীতির ইতিহাস। যেখানে শঙ্খ ও উলুধ্বনীর সঙ্গে আকাশে-বাতাসে ভাসে আজানের ধ্বনিও।