
Truth Of Bengal: রাজাগোপাল ধর চক্রবর্ত্তী: নেপালে হিন্দু রাষ্ট্র আর সাংবিধানিক রাজতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবিতে সারা দেশ জুড়ে চলছে আন্দোলন বিক্ষোভ ও অশান্তি। বহু মানুষ আহত, পুলিশের গুলিতে মারা গেছেন এক বিক্ষোভকারী আর আন্দোলন চলাকালীন আগুনে পুড়ে মারা যান এক কর্তব্যরত সাংবাদিক।
নেপালি ২০৮২ নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়ে এক ইঙ্গিতপূর্ণ বার্তায় বিদায়ী রাজা জ্ঞানেন্দ্র বলেছেন, ‘নাগরিক স্বাধীনতার গ্যারান্টি দেওয়ার ক্ষেত্রে গণতন্ত্রের চেয়ে বড় কোনও ব্যবস্থা নেই। জনগণের প্রশংসা এবং সমালোচনা উভয়ই শোনার ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতি থাকলেই সত্যিকারের গণতন্ত্র বিরাজ করে।’ রাজতন্ত্র এবং হিন্দু ধর্ম প্রতিষ্ঠার আন্দোলন হলেও, প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলি-সহ প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলির লাগামহীন দুর্নীতির বিরুদ্ধে মানুষকে সঙ্ঘবদ্ধ করে আবার পথে নামিয়েছে।
এর আগেই এই জনতাই পথে নেমেছিল রাজতন্ত্রকে সরাতে। উত্থান-পতনের দীর্ঘ সেই আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ নেয় ২০০৬ সালে। ভয়াবহ জনবিক্ষোভে ২৩ জন বিদ্রোহীর মৃত্যু ঘটলে, নিঃশব্দে ক্ষমতার অলিন্দ থেকে বেরিয়ে আসেন শেষ রাজা জ্ঞানেন্দ্র। রাজতন্ত্রের বিলোপও ঘটে সাংবিধানিক প্রক্রিয়ায়। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে। নেপালে রাজতন্ত্র থেকে গণতন্ত্র আবার রাজতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টাকে বুঝতে নেপালের রাজতন্ত্রের বিবর্তন নিয়ে একটু পেছনে ফেরা যাক।
আঠারো শতকের গোড়ার দিকে শাহ পরিবার নেপালের পার্বত্য এলাকায় গোর্খা বা গুর্খা রাজ্য দাপিয়ে রাজত্ব করতো। নেপাল উপত্যকা চালাতো মল্লরা। পারিবারিক অনৈক্য এবং ব্যাপক সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসন্তোষে মল্ল শাসনের দুর্বলতার সুযোগ দেখে গোর্খা শাসক পৃথ্বী নারায়ণ শাহ ১৭৬৯ সালে উপত্যকাটি জয় করেন এবং এর অল্প সময়ের মধ্যেই কাঠমান্ডুতে তার রাজধানী স্থানান্তরিত করেন।
এর থেকেই আধুনিক নেপাল রাষ্ট্রের ভিত্তি। পৃথ্বী নারায়ণ শাহ (শাসনকাল ১৭৪২-৭৫) এবং তাঁর উত্তরসূরিরা মধ্য হিমালয়ে একটি ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। এক সময়ে ভুটান থেকে কাশ্মীর পর্যন্ত সমগ্র পার্বত্য অঞ্চল তাদের কর্তৃত্বের অধীনে ছিল। নেপালিরা যুগ যুগ ধরে রাজাকে বিষ্ণুর অবতার বলে মানে। হিন্দু ধর্মগ্রন্থে এর কোনও স্বীকৃতি না থাকলেও শাহ রাজারা এই বিশ্বাসকে সম্পূর্ণ কাজে লাগিয়ে নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখেন।
শাহ শাসকরা দেশের বিবিধ বৈচিত্র্য দেখে আঞ্চলিক ও স্থানীয় অভিজাতদের, যেমন থাপা ও রানা পরিবারের সঙ্গে মিত্রতা করার প্রয়োজন করে, নিয়ে আসে তাদের প্রশাসনে। এতে প্রশাসন মর্যাদা পেলেও, বহু ক্ষেত্রে এরা রাজশক্তিকে দুর্বলও করে। দুই রাজা সিংহাসনে আরোহণের সময় নাবালক ছিলেন।
আভিজাত্যরা তরুণ শাসকদের পুতুল হিসাবে রেখে নিজেদের আর্থিক, সমাজিক ও সামরিক স্বার্থ চরিতার্থ করে। থাপারা বকলমে শাসন করে ১৮০৬ থেকে ১৮৩৭ আর রানাদের আধিপত্য ছিল একশো বছর- ১৮৪৬ থেকে ১৯৫১। অভিজাতদের ওপর নির্ভরশীলতাতেই ষড়যন্ত্র নেপালি রাজতন্ত্রের সঙ্গী হয়ে ওঠে। অবশ্যই এই রানাদের চালাকি ও বুদ্ধিমত্তার জন্যই নেপালে ব্রিটিশ শাসন চালু হয়নি। রানারা ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীর অত্যন্ত মূল্যবান গুর্খা ইউনিটগুলিতে নেপালিদের নিয়োগের অনুমতি দেয়। তাতেই কাজ দেয়।
ব্রিটিশ নিজেদের শাসন বসায়নি উপরক্ত দেশীয় ও বিদেশি আক্রমণ থেকে নেপালকে রক্ষার গ্যারান্টি দিয়েছিল। রানারা চিন ও তিব্বতের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখায় ব্রিটিশদের নেপাল নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামাতে হয়নি। তবে ভারতে ব্রিটিশ শাসন শেষ হলে, রানারা দুর্বল হয়ে পড়ে। রাজা ত্রিভুবন (শাসনকাল ১৯১১-৫৫) স্বাধীন ভারতের সমর্থনে রানাদের কর্তৃত্ব খর্ব করে। ভারতের নেতৃত্বের পরামর্শে নেপাল কংগ্রেস তৈরি হয়। এদের কাজ ছিল প্রশাসনে রাজাকে মদত জোগানো।
স্বৈরতন্ত্রের প্রতি অতিরিক্ত অভ্যস্ততা এবং গণতান্ত্রিক অভিজ্ঞতার অভাবে নেপালে একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রবর্তন প্রায় অসম্ভব হলেও ১৯৫৯ সালে একটি সংবিধান অনুমোদিত হয়। সংবিধান মোতাবেক জাতীয় পরিষদের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে নেপাল কংগ্রেস ব্যাপক সাফল্য পায় এবং নেপালের প্রথম জনপ্রিয় সরকার গঠন করে।
কিন্তু মন্ত্রিসভা এবং রাজা মহেন্দ্র (শাসনকাল ১৯৫৫-৭২) এর মধ্যে ক্রমাগত বিতর্কের কারণে রাজা ১৯৬০ সালের ডিসেম্বরে নেপালি কংগ্রেস সরকারকে বরখাস্ত করেন এবং দলের বেশিরভাগ নেতাকে কারারুদ্ধ করেন। ১৯৬২ সালে প্রথম সংবিধান বাতিল করে রাজাকে পূর্ণাঙ্গ ক্ষমতার অধিকারী করে একটি নতুন সংবিধান চালু করেন মহেন্দ্র। ভারতীয় ও চিন উভয় দেশের সঙ্গে ভাল সম্পর্ক রেখে রাজা মহেন্দ্র বিরোধীদের দুর্বল, বিশৃঙ্খল এবং নিরুৎসাহিত করে তোলেন। মহেন্দ্র ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে মারা গেলে পুত্র বীরেন্দ্র তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন ১৯৭৫ সালে।
রাজা বীরেন্দ্র তাঁর বাবার মতন ‘নির্দলীয়’ রাজনৈতিক ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক উন্নয়ন করতে চেয়েছিলেন কিন্তু রাজনৈতিক দূরদর্শিতার অভাবে রাজশাসনে ব্যর্থই ছিলেন। কিন্তু নির্দল না বহুদল এর সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য গণভোট করে বহুদলীয় রাজনীতির বীজ বপন করেছিলেন, যদিও ১৯৮০ সালের মে মাসে অনুষ্ঠিত গণভোটে দলহীন ব্যবস্থার সমর্থকরা খুব সামান্য ভোট জেতে।
জাতীয় পরিষদের নির্বাচন ‘দলহীন’ ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত হলেও বিভিন্ন রাজনৈতিক গোষ্টির উত্থান হয়। জন্ম নেয় কমিউনিস্ট দলের। তারা নেপাল রাজপথ উত্তাল করে তোলে সমগ্র আশি আর নব্বইয়ের দশক। দল ব্যবস্থায় সংঘটিত ১৯৯১ সালের সাধারণ নির্বাচন নেপাল কমিউনিস্ট পার্টি (ইউনিফাইড মার্কসবাদী-লেনিনবাদী)-সিপিএন (ইউএমএল) ২০৫ টি আসনের মধ্যে ৬৯টি আসন পায়, যদিও ১১০টি আসন নিয়ে নেপাল কংগ্রেস ক্ষমতা দখল করে।
নেপাল কংগ্রেস দলের জিপি কৈরলা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। ইতিমধ্যে কমিউনিস্টদের একটা অংশ আর উগ্র প্রতিবাদ চেয়ে নেপালের কমিউনিস্ট পার্টি (মাওবাদী) বা সিপিএন (এম) প্রতিষ্ঠা করে। এরা দ্রুত সংখ্যা ও শক্তিতে বাড়ে, গ্রামের গরিব মানুষকে সঙ্গে নিয়ে সশস্ত্র বিদ্রোহ ঘোষণা করে। সশস্ত্রভাবে রাজতন্ত্র উৎখাতের পক্ষে পথে নেমে মাওবাদীরা দেশকে কার্যত গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দেয়।
২০০১ সালের পয়লা জুন তদনীন্তন যুবরাজ দীপেন্দ্র রাজা বীরেন্দ্র ও রাজপরিবারের আরও আট সদস্যকে হত্যা করেন। পরের দিন দীপেন্দ্রও আত্মহত্যা করেন। জ্ঞানেন্দ্র অপ্রত্যাশিতভাবেই হয়ে ওঠেন নেপালের রাজা। রাজা জ্ঞানেন্দ্র শাহ এই শাহ বংশের শেষ সম্রাট। দার্জিলিংয়ের সেন্ট জোসেফ কলেজে ও কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী, জ্ঞানেন্দ্র রাজা মহেন্দ্রের (শাসনকাল ১৯৫৫-৭২) কনিষ্ঠ পুত্র।
নেপালের রাজ পরিবারের স্বাভাবিক রীতিতে ছোট ছেলের সিংহাসন দখলের সুযোগ নেই। তাই জ্ঞানেন্দ্র রাজনীতিতে বিশেষ নজর দেননি। প্রকৃতি সংরক্ষণ সংক্রান্ত ট্রাস্ট পরিচালনা সঙ্গে চা, তামাক এবং পাঁচ তারকা হোটেল প্রভৃতি পারিবারিক ব্যবসা নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন জ্ঞানেন্দ্র। ইতিমধ্যে মাওবাদীরা আর শক্তিশালী হয়েছে, তাদের নিয়ন্ত্রণ না করতে পেরে প্রধানমন্ত্রী দেউবা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা চেয়ে বসেন। কাজে লাগেনি।
দিশাহারা হয়ে ২০০৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে জ্ঞানেন্দ্র তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভাকে বরখাস্ত করে সরাসরি ক্ষমতা গ্রহণ করেন। জ্ঞানেন্দ্রর স্বেচ্ছাচারী রূপ এবার আর প্রকট হয়। সব দল জোট বাঁধে, শুরু হয় অবিরত বিক্ষোভ ও ধর্মঘট। আইন শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে সেনাবাহিনীর ডাক পড়ে। গণ আন্দোলনে ২৩ জনের প্রাণহানি হলে, জ্ঞানেন্দ্র দেওয়াল লিখন পড়তে বিলম্ব করেননি। সংসদ পুনর্বহাল হয় আর গিরিজা প্রসাদ কৈরালার নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিতও হয়। সংসদ রাজার ক্ষমতা আরও হ্রাস করার সিদ্ধান্ত নেয়।
২০০৬ সালের নভেম্বরে সরকার ও মাওবাদী বিদ্রোহীরা জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় একটি শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করে। ২০০৭ সালের জানুয়ারিতে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধান জারি করা হয়, ওই বছরের ডিসেম্বরে অবশেষে রাজতন্ত্রের বিলোপ ঘোষিত হয়। ২০০৮ সালের এপ্রিলে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে মাওবাদীরা সর্বাধিক আসন জেতে। ২৮ মে, ২০০৮ তারিখে নতুন জাতীয় পরিষদ নেপালকে একটি গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করলে আড়াইশো বছরের রাজকীয় শাসনের অবসান ঘটে। জ্ঞানেন্দ্র ২০০৮ সালের ১১ জুন কাঠমান্ডুর নারায়ণহিতি প্রাসাদ ছেড়ে নাগার্জুন প্রাসাদে চলে যান। জ্ঞানেন্দ্র প্রাসাদ ত্যাগ করলেও ব্যক্তিগত নাগরিক ও ব্যবসায়ী হিসেবে দেশেই থেকে যান।
ইতিহাসের চাকা ঘোরে, কিন্তু নেপালে ঘুরছে খুবই দ্রুততার সঙ্গে। সাতাত্তর বয়সী সেই পুরোনো রাজা জ্যানেন্দ্রকে ফিরিয়ে আনতেই জনতা আবার রাজপথে। রাস্তায় হাজার হাজার মানুষ, কাঁদানে গ্যাস, মারপিট, কারফিউ লেগেই আছে। শত শত মানুষকে আটক করা হয়েছে, তবু বিক্ষোভ অব্যাহত। এর মধ্যেই দু’জনের মৃত্যু সংবাদ এসেছে।
বোঝাই যাচ্ছে, নেপালের তরুণ গণতন্ত্র মানুষের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ। গত উনিশ বছরে ঘন ঘন ক্ষমতার হাতবদল (তেরোবার) বলে দিচ্ছে, গণতান্ত্রিক প্রশাসকেরা দেশ শাসনে তেমন পটু হননি। রাজশাসন ফিরিয়ে আনতে রাষ্ট্রীয় প্রজাতন্ত্রী পার্টি যথেষ্ট উদগ্রীব। ২০২২ সালের নির্বাচনে রাষ্ট্রীয় প্রজাতন্ত্র পার্টি তুলনামূলকভাবে ভাল করেছে। রাষ্ট্রীয় প্রজাতন্ত্র পার্টি ৫.৫ শতাংশ ভোট পেয়ে ২৭৫ সদস্যের বিধানসভায় ১৪টি আসন পায়। এটি অবশ্যই আগের নির্বাচনের চেয়ে উন্নতি, যখন তাদের মাত্র একটি আসন ছিল। তবে, রাজতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার পক্ষে থাকা দলটির পক্ষে অপ্রতিরোধ্য জনসমর্থন রয়েছে এমন ভাবা এখনও সঠিক হবে না।
দলহীন পঞ্চায়েতের দেশ নেপালে এখন রাজনৈতিক দলের ছড়াছড়ি। জাতীয় সংসদে বা প্রতিনিধি সভায়, নেপালি কংগ্রেস, নেপাল কমিউনিস্ট পার্টি (ইউএমএল), নেপাল কমিউনিস্ট পার্টি (মাওবাদী কেন্দ্র), রাষ্ট্রীয় স্বতন্ত্র পার্টি, রাষ্ট্রীয় প্রজাতন্ত্র পার্টি, নেপাল কমিউনিস্ট পার্টি (ইউনিফাইড সোশ্যালিস্ট) সহ চোদ্দটি রাজনৈতিক দল আছে।
প্রতিনিধি সভায় ২৭৫ জন সদস্য রয়েছে। এর মধ্যে ১৬৫ জন একক সদস্য নির্বাচনী এলাকা থেকে ফার্স্ট-পাস্ট-দ্য-পোস্ট ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হন। এই মিশ্র নির্বাচনী ব্যবস্থায় কোনও একক দলের পক্ষে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করা কঠিন। এজন্য নেপালে প্রায়ই জোট সরকার দেখা যায়। যে কোনও সরকার তৈরি হয় রাজনৈতিক দর কষাকষির উপর ভিত্তি করে। এতে দুর্নীতির সুযোগ সৃষ্টি হয়, সমর্থনের বিনিময়ে বিরাট অঙ্কের টাকা ঘোরা ফেরা করে, সঙ্গে আসে রাজনৈতিক অস্থিরতাও।
নেপালে মূল রাজনৈতিক দলগুলি আস্থা হারাচ্ছে, নতুন রাজনৈতিক শক্তি উল্লেখযোগ্য প্রভাব বিস্তার করেছে। সাধারণ নির্বাচনের মাত্র কয়েক মাস আগে নেপালি টেলিভিশন উপস্থাপক রবি লামিচানের নেতৃত্বে রাষ্ট্রীয় স্বতন্ত্র পার্টি গঠিত হলেও এটি দেশের চতুর্থ বৃহত্তম দল। নেপালের কাঠমান্ডুর বর্তমান মেয়র বালেন শাহ একজন জনপ্রিয় গায়ক। বোঝাই যাচ্ছে প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলের প্রতি হতাশা থেকেই মানুষ এই ভাবে দলের বদলে ব্যক্তিকে বেছে নিচ্ছেন।
আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল নেপালের বিশাল সংখ্যক অনাবাসী। অনাবাসীরা দেশের জনসংখ্যার প্রায় এক তৃতীয়াংশ। অনাবাসী রেমিট্যান্স নেপালের অর্থনীতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ২০২৩ সালে অনবাসীরা আনুমানিক ১১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার দেশে পাঠিয়েছিল। এটা নেপালের জাতীয় আয়ের ২৬.৬ শতাংশ। অনবাসীরা ফেল না নয় এদের কথা সরকার না শুনলেও পরিবার শুনবে। অন্যান্য দেশগুলি কীভাবে এগিয়েছে তা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করে অনাবাসী নেপালি জনতা তাদের পরিবারকে দুর্নীতি পরায়ণ রাজনৈতিক নেতাদের বিসর্জন দেওয়ার উপদেশ দেওয়াই স্বাভাবিক।
নেপালে এখন ‘যুব স্ফীতি’ চলছে। ১৬-২৫ বছর বয়সী তরুণ জনগোষ্ঠী জনসংখ্যার প্রায় ২০.৮ শতাংশ এবং জনসংখ্যার ৪০.৬৮ শতাংশ ১৬-৪০ বছর বয়সী। এদের সকলেই রাজনীতিকদের দুর্নীতি দেখেছে স্বচক্ষে বা মিডিয়ার উপস্থাপনে। রাজ শাসনের কালো মেঘ দেখার অভিজ্ঞতা এদের খুবই কম। এই তরুণরই ভিড় করছে রাজাকে ফিরিয়ে আনার রাজনৈতিক কর্মসূচিতে।
তাছাড়া, নেপালে যুব বেকারত্ব একটি উল্লেখযোগ্য সমস্যা, ২০২৩ সালে যুব বেকারত্বের হার প্রায় ২০.৩৬ শতাংশ। এই হার জাতীয় গড় বেকারত্বের হারের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি। এদের হতাশাই এদের পথে নামছে। প্রচলিত ব্যবস্থাকেই এরা দায়ী মনে করে পুরানো রাজতন্ত্রে ফেরত যেতে চায়। নেপালের রাজতন্ত্র এবং তার হিন্দু পরিচয় ঐতিহাসিকভাবেই সংযুক্ত। রাজাকে ঐতিহ্যগতভাবে বিষ্ণুর অবতার হিসাবে বিবেচনা করা হয়, যার ফলে হিন্দু জাতীয়তাবাদকে রাজতন্ত্রবাদী মনোভাব থেকে আলাদা করা কঠিন।
নেপালের তরাই অঞ্চলে নেপালকে হিন্দু রাষ্ট্র ঘোষণার দাবি বড়ই সক্রিয়। একটি জনসভা চলাকালীন রাজা জ্ঞানেন্দ্রর ছবির পাশে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের একটি বড় পোস্টার দেখা যায়। যোগী আদিত্যনাথের গোরক্ষনাথ মঠের মাধ্যমে নেপালের রাজতন্ত্রের সঙ্গে ঐতিহাসিক সম্পর্ক রয়েছে। উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার আগে তিনি হিন্দু রাষ্ট্র হিসাবে রাজতন্ত্র এবং নেপাল উভয়ের পক্ষে সোচ্চার ছিলেন।
তার এসব বক্তব্যের পুরনো ভিডিও এখন নেপালের সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘুরে বেড়াচ্ছে, যা ভারতীয় সংশ্লিষ্টতা নিয়ে জল্পনা-কল্পনা বাড়িয়ে তুলছে। প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলি সম্প্রতি ইঙ্গিত দিয়েছেন যে ভারত আসলে এই রাজতন্ত্রপন্থী বিক্ষোভে ইন্ধন দিচ্ছে। তবে সত্যি কথা বলতে, মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে যোগী আদিত্যনাথ নেপালের রাজতন্ত্র নিয়ে প্রকাশ্যে কোনও মুখ খোলেননি।
নেপালের রাজতন্ত্রবাদীরা কৌশলগতভাবে তার অতীত বিবৃতি এবং চিত্রকল্প ব্যবহার করে বোঝাতে চাইছে যে ভারত তাদের আন্দোলনকে সমর্থন করে। বস্তুত, নেপালের পররাষ্ট্রমন্ত্রী রাইসিনা সংলাপে সরাসরি ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে, ভারত রাজতন্ত্রপন্থী বিক্ষোভকে সমর্থন করছে কিনা। ভারত স্পষ্টভাবে তা অস্বীকার করেছে।
ভারতের ঘোষিত অবস্থান হল, নেপালের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার সে দেশের জনগণ এবং সরকারের সিদ্ধান্ত। নেপালের যুক্তরাষ্ট্রীয় ভাবনা, প্রজাতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা অত্যন্ত স্পর্শকাতর। এখানে কোনওরূপ বক্তব্য ভারত সরকারের থাকার কথা নয়, নেইও। ঐতিহাসিকভাবে, নেপালের রাজতন্ত্রবাদী এবং কমিউনিস্ট উভয়ই বিভিন্ন সময়ে ভারতবিরোধী জাতীয়তাবাদকে উস্কে দিয়েছে।
রাজা জ্ঞানেন্দ্র নিজে ২০০৫ সালে নিরঙ্কুশ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর ঢাকা শীর্ষ সম্মেলনে সার্কভুক্ত চিনের অন্তর্ভুক্তির জন্য সক্রিয়ভাবে তদবির করেছিলেন। তাই ভারত সরকার সবার সঙ্গে কথা বলবে, কিন্তু কারও পক্ষে থাকবে না। বাংলাদেশের আওয়ামী লীগের সরকারের সঙ্গে ভারত সরকারের মাখামাখি এখন সে দেশের সম্পর্কের কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সত্তরের দশকে চিন নিজের ঘর ঘোচাতে ব্যস্ত ছিল, তাই যে সহজে ভারত প্রতিবেশী দেশে মিশতে পেরেছিল, এখন আর তা সম্ভব নয়।
ভারত কোনও ধারণা বা দলের সমর্থনে থাকলে, অন্য ভাবনার মানুষ চিনের দিকে ছুটবে। তাতে অবস্থা কেবল জটিল হবে। তাই ভারতকে নেপালের রাজতন্ত্র প্রতিষ্টার আন্দোলনে দৃশ্যত নিরপেক্ষ থাকাই বাঞ্ছনীয়। চিন জানে বহু গোষ্ঠীতে বিভক্ত মাওবাদীদের থেকে রাজাকে বশ মানানো অনেক সহজ। হয়তো চিনই একদিন রাজতন্ত্রের বড় সমর্থক হয়ে উঠবে। ভারত সে জায়গায় নেই।